পবিত্র কোরআন সম্পূর্ণ মুখস্থ করা মোটেই সহজ কাজ নয়। এর জন্য হিফজ বিভাগের প্রতিটি হাজার হাজার ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াতে ব্যস্ত থাকতে হয়। আবার হাফেজ হওয়ার পরও হেফজ ধরে রাখার জন্য তাঁদের অনেক বেশি পরিমাণে কোরআন তিলাওয়াত করতে হয়। আর বেশি পরিমাণে কোরআন তিলাওয়াতকারীদের মহানবী (সা.) আল্লাহর পরিজন বলে সম্বোধন করেছেন।
আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, কিছু মানুষ আল্লাহর পরিজন। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা? তিনি বলেন, কোরআন তিলাওয়াতকারীরা আল্লাহর পরিজন এবং তাঁর বিশেষ বান্দা। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫)
বিভিন্ন হাদিসে কোরআনের হাফেজ, বেশি তিলাওয়াতকারী ও কোরআন অনুযায়ী আমলকারীদের বহু ফজিলত পাওয়া যায়। নিম্নে কোরআনে হাফেজদের কিছু মর্যাদা তুলে ধরা হলো:
কোরআনের জ্ঞান ঈর্ষণীয় সম্পদ : কোরআনের জ্ঞান ও তার তিলাওয়াতের তাওফিক আল্লাহর অনন্য নিয়ামত। যে নিয়ামতের ব্যাপারে ঈর্ষা করা জায়েজ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, দুই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে ঈর্ষা করা যায় না। এক ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং সে তা দিন-রাত তিলাওয়াত করে। আর তা শুনে তার প্রতিবেশীরা তাকে বলে, হায়! আমাদের যদি এমন জ্ঞান দেওয়া হতো, যেমন অমুককে দেওয়া হয়েছে, তাহলে আমিও তার মতো আমল করতাম। অন্য আর এক ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন এবং সে সম্পদ সত্য ও ন্যায়ের পথে খরচ করে। এ অবস্থা দেখে অন্য এক ব্যক্তি বলে, হায়! আমাকে যদি অমুক ব্যক্তির মতো সম্পদ দেওয়া হতো, তাহলে সে যেমন ব্যয় করছে, আমিও তেমন ব্যয় করতাম। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫০২৬)
কোরআন কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে: দুনিয়ায় যারা কোরআন চর্চা করবে, মহান আল্লাহর হুকুমে কিয়ামতের দিন পবিত্র কোরআন তাদের জন্য সুপারিশ করবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সিয়াম এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম (রোজা) বলবে, হে রব, আমি তাকে দিনে খাবার গ্রহণ করতে ও প্রবৃত্তির তাড়না মেটাতে বাধা দিয়েছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ কবুল করো। কোরআন বলবে, হে রব, আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। ’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ১৮৩৯)
কোরআনচর্চাকারীকে বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হবে : যারা দুনিয়াতে কোরআন শিখবে সে মতে আমল করবে, কোরআন হিফজ করবে। কিয়ামতের দিন তাদের বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, কোরআন কিয়ামত দিবসে হাজির হয়ে বলবে, হে আমার প্রভু, একে (কোরআনের বাহককে) অলংকার পরিয়ে দিন। তারপর তাকে সম্মান ও মর্যাদার মুকুট পরানো হবে। সে আবার বলবে, হে আমার প্রভু, তাকে আরো পোশাক দিন। সুতরাং তাকে মর্যাদার পোশাক পরানো হবে। সে আবার বলবে, হে আমার প্রভু, তার প্রতি সন্তুষ্ট হোন। কাজেই তিনি তার ওপর সন্তুষ্ট হবেন। তারপর তাকে বলা হবে, তুমি একেক আয়াত পাঠ করতে থাকো এবং ওপরের দিকে উঠতে থাকো। এমনিভাবে প্রতি আয়াতের বিনিময়ে তার একটি করে সওয়াব (মর্যাদা) বাড়ানো হবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৯১৫)
কোরআনের হাফেজদের ফেরেশতাদের সঙ্গে তুলনা : পবিত্র কোরআন হিফজ করা, চর্চা করা এতটাই ফজিলতপূর্ণ কাজ যে রাসুল (সা.) তার হিফজকারীদের ফেরেশতাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, কোরআনের হাফেজ পাঠক লিপিকর সম্মানিত ফেরেশতাদের মতো। খুব কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও যে বারবার কোরআন পাঠ করে, সে দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে। (বুখারি, হাদিস : ৪৯৩৭)
কোরআন শিক্ষা সম্পদ অর্জনের চেয়েও উত্তম : উকবাহ ইবনে আমির (রা.) বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) এলেন। তখন আমরা সুফফাহ বা মাসজিদের চত্বরে অবস্থান করছিলাম। তিনি বলেন, তোমরা কেউ চাও যে প্রতিদিন বুত্বহান বা আকিকের বাজারে যাবে এবং সেখান থেকে কোনো পাপ বা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ছাড়াই বড় কুঁজ বা চুঁটবিশিষ্ট দুটি উটনী নিয়ে আসবে? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা এরূপ চাই। তিনি বলেন তাহলে কি তোমরা কেউ মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাবের দুটি আয়াত শিক্ষা দেবে না কিংবা পাঠ করবে না? এটা তার জন্য ওইরূপ দুটি উটনীর চেয়েও উত্তম। এরূপ তিনটি আয়াত তিনটি উটনীর চেয়েও উত্তম এবং চারটি আয়াত চারটি উটনীর চেয়েও উত্তম। আর অনুরূপ সমসংখ্যক উটনীর চেয়ে ততসংখ্যক আয়াত উত্তম। (মুসলিম, হাদিস : ১৭৫৮)
কোরআনের ধারকদের সম্মানের নির্দেশ : নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে কোরআনের ধারক-বাহকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। যারা ৩০ পারা কোরআন হেফজ করে তা ধরে রাখে, তার ওপর আমল করে, তারাও সেই সম্মানের যোগ্য। আবু মুসা আল-আশআরি (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কোরআনের ধারক-বাহক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রতি সম্মান দেখানো মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৪৩)
কোরআন পাঠকারীর মা-বাবাকে বিশেষ সম্মাননা : সাহল ইবনু মুআজ আল-জুহানি (রহ.) থেকে তার পিতা থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করে এবং তা অনুযায়ী আমল করে, কিয়ামতের দিন তার মা-বাবাকে এমন মুকুট পরানো হবে যার আলো সূর্যের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল হবে। ধরে নাও, যদি সূর্য তোমাদের ঘরে বিদ্যমান থাকে (তাহলে তার আলো কিরূপ হবে?)। তাহলে যে ব্যক্তি কোরআন অনুযায়ী আমল করে তার ব্যাপারটি কেমন হবে, তোমরা ধারণা করো তো!’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৫৩)
তাই আমাদের উচিত, সম্ভব হলে নিজেই কোরআন হেফজ শুরু করা, তা সম্ভব না হলে কমপক্ষে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা, আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কোরআনে হাফেজ বানানোর চেষ্টা করা। এর জন্য ছোট থেকেই তাদের সেভাবে গড়ে তুলতে হবে, মহান আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করতে হবে। মহান আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন ।