আমাদের অনেক গা সওয়া ইস্যুর একটি হচ্ছে ‘সিসা’। সম্প্রতি সিসা নিয়ে প্রকাশিত এক গবেষণার ফলাফল নিয়ে সবাই আবার নড়েচড়ে বসার ভাবে আছেন। সাধারণ মানুষ যাকে কলেরা হাসপাতাল বলে, সেই আইসিডিডিআরবির একটি গবেষণায় অংশ নেওয়া ৫০০ শিশুর মধ্যে ৯৮ শতাংশের রক্তে সিসার মাত্রা নিরাপদ সীমার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়েছে। এটি ভয়ের কিন্তু নতুন কোনো তথ্য কি? গত বছর এক সিসা সভায় বলা হয়েছিল, দেশে সাড়ে তিন কোটির বেশি শিশুর রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিসাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছে অনেক আগেই। ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএমই) ধারণা মতে, সিসা দূষণের কারণে বিশ্বের প্রায় ১০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে মৃত্যু ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ কোটি শিশুর রক্তে উচ্চমাত্রায় সিসা আছে। এদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের দেশে বসবাসরত। কারণ, সেখানে সিসার অধিক ব্যবহার ও দূষণ হয়ে থাকে এবং উচ্চ আয়ের দেশগুলোর মতো নজরদারি ও নিয়ন্ত্রিত হয় না।
প্রতিবছর ২০ থেকে ২৬ অক্টোবর দেশের বড় বড় হোটেলে ঢাকঢোল পিটিয়ে খানাপিনার সঙ্গে বড় করে সিসা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিসা সর্বনাশের বয়ান চলে। সপ্তাহজুড়ে শিশুদের নিয়ে র্যালি, মানববন্ধন ইত্যাদি হয় নানা শহরে। আলোচনা, সেমিনার সেখানেও হয়। সপ্তাহজুড়ে সেসবের ছবি ছাপা হয়। যাদের টাকায় এসব মিটিং মিছিল তাদের কাছে প্রকল্প সমাপনী প্রতিবেদনে সেসব ছবি দিতে হয়। ঢাকার অনুষ্ঠানে রাখঢাক ছাড়াই প্রতিবারই জানানো হয়- গবেষণা চলছে, আরও নামজাদা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দফায় দফায় কথিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস)’ করা হচ্ছে/হবে। সিসার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ চলমান আছে- ‘জং জারি হ্যায়’ (বলে রাখা ভালো, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণের পর তাদের প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এই আশ্বাসের বাণীই শুনিয়েছিলেন- আত্মসমর্পণের মানে এই নয় যে যুদ্ধ শেষ, যুদ্ধ চলবে- জং জারি হ্যায়।) সিসার যুদ্ধে অনেক আগেই আমরা দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণ করলেও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ভাব ধরে আছি।
বিভিন্ন দাতা সংস্থা আর শিশুদের জন্য কান্নাকাটি করতে করতে যাদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে- এমন সব প্রতিষ্ঠান মিলে গড়ে তুলেছে ‘পার্টনারশিপ ফর এ লেড-ফ্রি ফিউচার’ (পিএলএফ)। পিএলএফের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে শিশুদের সিসার বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত রাখা। এর মাধ্যমে তারা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে সিসা দূষণ রোধ করার জন্য জানকবুল প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে। গত দশকে এ রকম আরেকটি জানকবুল প্রতিজ্ঞা ছিল ‘২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’। পিএলএফ উদ্যোগটি মূলত ইউনিসেফের ‘হেলদি এনভায়রনমেন্টস ফর চিলড্রেন ইনিশিয়েটিভ’ (এইচইএইচসি)-এর একটি অংশ এবং শিশুদের পরিবেশগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। কাগজে-কলমে পিএলএফের প্রধান উদ্দেশ্য হলো :
১. শিশুদের রক্তে সিসার সংস্পর্শ কমানো এবং সিসাঘটিত রোগ প্রতিরোধ করা।
২. সিসা দূষণ রোধে জাতীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করা।
৩. সিসামুক্ত ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে সহযোগিতা করা।
৪. সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নীতিনির্ধারকদের উৎসাহিত করার মাধ্যমে সিসা দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
সিসার বিপজ্জনক মাত্রা কী : মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) রক্তে সিসার মাত্রা প্রতি লিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়াকে উদ্বেগের কারণ বলে মনে করে। বাংলাদেশের গবেষকরা দেহে প্রতি লিটার রক্তে ৬৭ মাইক্রোগ্রাম সিসা খুঁজে পেয়েছেন। তার মানে যুক্তরাষ্ট্রের নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ মাত্রায় সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে এ দেশের শিশুদের মধ্যে। প্রধানত বস্তির শিশুদের ওপর পরিচালিত এই গবেষণা হলেও যারা বস্তিতে থাকে না কিন্তু বস্তিবাসীর সেবা নেয়, তাদের উল্লসিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। বলা হচ্ছে, সিসা দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। দেশে সাড়ে তিন কোটির বেশি শিশুর রক্তে সিসা রয়েছে বিপজ্জনক মাত্রায়। এর মধ্যে আমার আপনার শিশু আছে।
কীভাবে ঢুকছে শরীরে : গবেষকরা বলছেন, প্রসাধনী থেকেও শিশুদের শরীরে ‘উচ্চমাত্রায়’ সিসা দূষণ বিস্তার লাভ করতে পারে। অন্য যেসব উৎস থেকে মানুষ সিসার কাছাকাছি আসে তার মধ্যে রয়েছে সিসা ও ব্যাটারি-সম্পর্কিত শিল্প, সিসা-ভিত্তিক রঙ ও প্রসাধনী এবং রান্নার পাত্র ও অন্যান্য তৈজসপত্রের মতো ভোগ্যপণ্য থেকে। এ ছাড়াও ঘরের ভেতরে ধূমপান থেকেও সিসার বিষক্রিয়া হতে পারে। এটা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে, খাবারের মাধ্যমে, ত্বকের শুষে নেওয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের মাধ্যমেও সন্তানের শরীরে যেতে পারে।
সিসামিশ্রিত রঙ বা লেড পেইন্ট : অনেক দেশ রঙে সিসার পরিমাণ কমানোর জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৮ সালে বাড়িঘরে, স্কুলে, জেলখানায়, হাসপাতালে- মানে যেখানেই মানুষ থাকে সেখানে সিসা আছে এমন রঙের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যভুক্ত অন্তত ৭৬টি দেশে সিসামিশ্রিত রঙের উৎপাদন, আমদানি, বিক্রয় ও ব্যবহারের বিষয়ে কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্যবাধকতা নেই।
রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে সিসা দূষণ : দেশের আনাচে-কানাচে সোলার প্যানেল ব্যবহার, ঢাকাসহ দেশের সব জায়গায় ব্যাটারি রিকশার সঙ্গে সঙ্গে কম দামের ব্যাটারিচালিত মোটরযানের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে এলআইসিতে লেড-অ্যাসিড ব্যাটারির ব্যবহার মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় সব লেড-অ্যাসিড ব্যাটারিই পুরনো ব্যাটারি, রিসাইকেল করা আর ফেলে দেওয়া ধাতু থেকে তৈরি করা হয়।
মাটি ও ধাতুর তৈজসপত্র : একদিকে অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের উচ্চ চাহিদা আর অন্যদিকে পুনঃচক্রায়ন বাজার থেকে বিপুল পরিমাণে এর সরবরাহের কারণে বর্তমান পৃথিবীতে বিশাল এক অ্যালুমিনিয়ামশিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মাটির তৈজসপত্র চকচকে করার কাজে সিসার প্রলেপ ব্যবহার করে সেটাকেও ক্ষতিকর করে তোলা হচ্ছে।
মসলা : মাত্রারিক্ত সিসা পাওয়া যাওয়ায় ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের হলুদগুঁড়া বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিল। গবেষকরা বলছেন, মসলার রঙ উজ্জ্বল করার জন্য লেড ক্রোমেট নামের এক সস্তা রাসায়নিক মাশানো হয়।
সিসা শিশুর শরীরে কী প্রভাব ফেলতে পারে : সিসার বিষক্রিয়া শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের বিকাশকে স্থায়ীভাবে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে বুদ্ধিমত্তার পরিমাণ (আইকিউ) কমে যায়, আচরণগত পরিবর্তন হয়- যার মধ্যে মনোযোগের সময়কাল কমে যায়, পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে।
সিসার কারণে রক্তাল্পতা, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির দুর্বলতা, প্রজনন অঙ্গের বিষাক্ততা এবং ইমিউনোটক্সিসিটিও দেখা দিতে পারে। এসব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথা। অতি তীব্র মাত্রার সমস্যা ছাড়া এটা বোঝা কঠিন যে শিশুর সিসার প্রভাবে এসব জটিলতা হচ্ছে, এ জন্য বিষয়টি বাড়তি উদ্বেগের।
বাঁচার উপায় কি কিছু আছে : সিসা-দূষিত মাটি ও পানির উৎসগুলো চিহ্নিত করে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে প্রতিকারের ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশে শিশুদের জন্য সিসা দূষণের একটি প্রধান কারণ হলো সিসা-দূষিত ধুলাবালি ও মাটি। আজকাল গ্রাম-শহর-নির্বিশেষে অনেক বাড়িতে সিসাভিত্তিক রঙ ব্যবহার করা হয়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশে সিসা কণা ছড়াতে থাকে। যে শিশুরা মাটিতে খেলে বা দূষিত বস্তু নাড়াচাড়া করে তারা অজান্তে সিসার ধূলিকণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে এবং দীর্ঘস্থায়ী দূষণের কবজায় চলে যায়। শিশুকে নিরাপদ রাখতে হলে স্কুলে, বাড়িতে, পার্কে রঙ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হতে হবে। ব্যাটারিচালিত খেলনার ক্ষেত্রেও আমাদের সতর্ক হতে হবে।
যানবাহন, সৌরশক্তি সিস্টেম এবং বাড়ি ও ব্যবসার জন্য ব্যাকআপ পাওয়ার উৎস হিসেবে সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারির ব্যবহার আধুনিক জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এগুলোর ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়ছে। তাই আধুনিক ও নিরাপদ ব্যাটারি ব্যবস্থাপনার জন্য কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশের কিছু এলাকায় নদীর গভীরতা নির্ণয় ব্যবস্থায় এবং পানি সরবরাহ পরিকাঠামোতে সিসাযুক্ত পাইপ ব্যবহার করা হয়। এই সিস্টেমগুলোর মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি সিসা কণা সংগ্রহ করতে পারে, যা পানি সরবরাহকে দূষিত করে।
সিসার বিষক্রিয়া চিনতে এবং চিকিৎসা করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। প্রাথমিক পদক্ষেপ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সিসা দূষণের কিছু ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে পারে।
গত বছরের সিসা সংলাপে জাতিসংঘের শিশু তহবিল সিসা দূষণ মোকাবিলায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি পরীক্ষা করার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবেশ খাতের পরীক্ষাগারের সক্ষমতা জোরদার করতে একটি বহুখাতীয় কর্মপরিকল্পনার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। বলেছিল, তারা দক্ষতা দিয়ে এই কাজে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। সিসামুক্ত বাংলাদেশের জন্য সবার আগে দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। ভোট-জ্বরে আক্রান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সিসায় শিস দেওয়ার সময় কখনও হবে কি? শিশুরা তো ভোটার নয়।
গওহার নঈম ওয়ারা : লেখক ও গবেষক