দেশে যানবাহন চালকের লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটি সব লাইসেন্সধারী চালকের তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণ করে। কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকে লাইসেন্স দেওয়া ও তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণের কাজ ঠিকঠাকভাবে করতে পারছে না সংস্থাটি। এ ছাড়া দিতে পারছে না ড্রাইভিং লাইসেন্স। অথচ আবেদনকারীর টাকা জমা দেওয়া আছে। পরীক্ষাও শেষ। কাজ বাকি শুধু একটি, ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্টকার্ড প্রিন্ট করে গ্রাহককে দেওয়া। এ কাজটিই করতে পারছে না সরকারি এই সংস্থা। ফলে ৭ লাখের বেশি মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন। কারও কারও অপেক্ষা তিন থেকে চার বছরের। ঠিকাদারের মেয়াদ শেষ। নতুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এখনও চুক্তি হয়নি। বাধ্য হয়ে ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে সংকট গোছানোর চেষ্টা করছে বিআরটিএ।
সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গত বছর ১৮ আগস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, লাইসেন্সের ক্ষেত্রে তিনিও ভুক্তভোগী। তার গাড়ির চালককে লাইসেন্স করাতে সাতবার ছুটি নিতে হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, নতুন ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে কার্যাদেশ পর্যন্ত কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে। সংকট শুরু হয়েছিল মূলত পছন্দের ঠিকাদারকে কার্ড ছাপানোর কাজ দেওয়াকে কেন্দ্র করে। সেই ঠিকাদার ছিল মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড (এমএসপি)। ভারতীয় এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে তৎপর ছিলেন সড়ক মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএর তখনকার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। ২০২০ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৫ বছর মেয়াদে এমএসপি এই কাজের দায়িত্বে ছিল। এমএসপির সঙ্গে চুক্তি শেষ হয় ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই।
ফলে গত ২৯ জুলাই থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্ট, বায়োমেট্রিক ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ সব কাজ বন্ধ। পরিস্থিতি সামলাতে কম্পিউটারে কাগজ প্রিন্ট দিয়ে লাইসেন্স হিসেবে চালাতে বলছে বিআরটিএ; এর নাম দেওয়া হয়েছে ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স। স্মার্টকার্ড যথাসময়ে দিতে না পেরে বিআরটিএ গ্রাহককে এই কাগুজে লাইসেন্স দিচ্ছে। সেটা দেখালে ট্রাফিক পুলিশ আইনি ব্যবস্থা থেকে বিরত থাকে। অবশ্য সবচেয়ে ভোগান্তিতে আছেন লাইসেন্স নিয়ে বিদেশে কর্মী হিসেবে যেতে আগ্রহীরা। কারণ, স্মার্টকার্ড ছাড়া তারা বিদেশে যেতে পারছেন না।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, সমস্যার সমাধানে তারা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সার্ভারের নিয়ন্ত্রণসহ ডেটাবেইসের অ্যাকসেস নিজেদের হাতে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। গতকাল থেকে ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আগের জারি করা এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটি প্রচারের চেষ্টা করছে সংস্থাটি। ২০২৪ সালের ১ এপ্রিলের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স সমানভাবে গ্রহণযোগ্য।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি জানান, ওটিএমে (উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি) নতুন ঠিকাদার নিয়োগের কাজ চলছে। ই- ড্রাইভিং লাইসেন্স চালু আছে।
সূত্র মতে, হাসিনার আমলে সড়ক মন্ত্রণালয়ের প্রভাব দেখিয়ে কাজ নেওয়ার অভিযোগ আছে। এমএসপি চাহিদা অনুযায়ী কার্ড দিতে পারেনি। অজুহাত হিসেবে তারা কখনও করোনা মহামারি, কখনও ঋণপত্র খোলায় জটিলতার বিষয়টি সামনে এনেছে। অন্যদিকে আবেদনকারীদের ভোগান্তি বেড়েছে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, লাইসেন্স সংক্রান্ত ডেটাবেইস ও সার্ভারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখনও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে। ডেটাবেইসে বিআরটিএর নিজস্ব অ্যাকসেস নেই।
দরপত্র মূল্যায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে মাদ্রাজ প্রিন্টার্স বিআরটিএ ও সড়ক মন্ত্রণালয়ে তিন দফা অভিযোগ করে জানায়, সর্বনিম্ন দরদাতা সেল্প সলিউশনের আইএসও (আন্তর্জাতিক মান সংস্থা) সনদ মেয়াদোত্তীর্ণ। পরে দরপত্র বাতিল করে দেয় সড়ক মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালে আবারও দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং লাইসেন্স সরবরাহের সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৪০ লাখ। দ্বিতীয় দফার দরপত্রে সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পান আগের তিন ঠিকাদারই। যদিও পরে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় মাদ্রাজ প্রিন্টার্স। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ৫ বছরে ৩৩ লাখের মতো আবেদন জমা পড়ে। এগুলোর মধ্যে প্রায় ২৬ লাখ গ্রাহক লাইসেন্স পেয়েছেন, বাকি ৭ লাখ এখনও পাননি, অর্থাৎ এই ৭ লাখ লাইসেন্স প্রিন্ট করতেই পারেনি ঠিকাদার। তার আগেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।