দেশের অন্যতম ব্যস্ত ও জনপ্রিয় পর্যটন বিমানবন্দর কক্সবাজার পরিণত হয়েছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়। প্রতিদিনই রানওয়েতে প্রবেশ করছে কুকুরসহ বিভিন্ন প্রাণী, যা পাইলটদের জন্য সৃষ্টি করছে তীব্র উদ্বেগ ও আতঙ্ক। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোয় দেখা গেছে, টেকঅফ বা অবতরণের সময় উড়োজাহাজ কুকুরের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে; এমনকি চলন্ত উড়োজাহাজের নিচে পড়ে প্রাণীর মৃত্যুও ঘটেছে। অথচ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকেই যাচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার বিকালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ টেকঅফের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ একটি কুকুর রানওয়েতে ছুটে আসে এবং উড়োজাহাজটির নিচে পড়ে মারা যায়। পাইলট জরুরি সতর্কতা অবলম্বন করে বিমান থামিয়ে বড় দুর্ঘটনা এড়ান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিমানবন্দর কর্মীরা হতবাক হয়ে যান। ইউএস-বাংলার পাইলটরা বলেন, ‘এটি শুধু প্রাণীর মৃত্যু নয়, এমন ঘটনার কারণে কয়েকশ যাত্রীর জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারত।’ পাইলটদের অভিযোগ, কক্সবাজারে নামার সময় প্রায়ই রানওয়েতে কুকুর দেখা যায়। এতে হঠাৎ গতি কমানো বা ব্রেক করতে হয়, যা যাত্রীদের জন্য বিপজ্জনক। একজন পাইলট বলেন, ‘কক্সবাজারে অবতরণের সময় আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি যে, রানওয়েতে কুকুর দেখতে পারি। এটি এখন এক অদৃশ্য আতঙ্ক।’
বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থার অন্যতম দায়িত্ব হলো রানওয়েকে প্রাণী ও অনাকাক্সিক্ষত বস্তুর হাত থেকে সুরক্ষিত রাখা। কিন্তু কক্সবাজার বিমানবন্দরে সেই নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই বললেই চলে। পাইলটদের অভিযোগ, প্রায়ই অবতরণের সময় তাঁরা রানওয়েতে কুকুর দেখতে পান।
রানওয়েতে কুকুর প্রবেশের ঘটনা নতুন নয়, তবু বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের তৎপরতা আশানুরূপ নয়। বিমানবন্দর ঘিরে থাকা সীমানা প্রাচীরের অসংখ্য স্থানে ছিদ্র রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, এই ছিদ্র দিয়েই কুকুরসহ বিভিন্ন প্রাণী সহজেই ভেতরে ঢুকে রানওয়েতে চলে আসে। অনেক সময় রাতে বা ভোরে কুকুরের দল সেখানে ঘোরাফেরা করে, যা ফ্লাইটের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে কুকুর ধরার অভিযানে নামে কিন্তু নিয়মিত নয়। এসব অভিযানে ধৃত কুকুর কিছুদিন পর আবার ফিরে আসে। স্থায়ী সমাধান হিসেবে সীমানা প্রাচীর মেরামত ও নতুন নিরাপত্তাব্যবস্থা স্থাপনের কথা বলা হলেও বাস্তবায়ন হয়নি।
অন্য বিমানবন্দরগুলোয় ‘বার্ড শুটার’ বা প্রাণী তাড়ানোর বিশেষ দল থাকে। তাদের কাজ রানওয়ে ও আশপাশে প্রাণীর উপস্থিতি শনাক্ত করে দ্রুত তাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু কক্সবাজার বিমানবন্দরে এমন কোনো দল নেই। এমনকি নিয়মিত টহল কার্যক্রমও অনেকটা আনুষ্ঠানিকভাবে চালানো হয়। ফলে প্রাণী প্রবেশের সুযোগ থেকে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিমানবন্দর কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের এখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী নেই। আবার অনেক সময় স্থানীয় এলাকাবাসী প্রাচীরের গায়ে গর্ত করে। এই গর্ত দিয়েই কুকুর ঢোকে। বাজেটের অভাবে মেরামতও নিয়মিত করা সম্ভব হয় না।’
গত বৃহস্পতিবারের ঘটনাটি মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এখনও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। ইউএস-বাংলার পাইলট ও অন্য বিমান সংস্থার কর্মকর্তারা বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ জানালেও তা গুরুত্ব পায়নি।
এ বিষয়ে ইউএস-বাংলার জনসংযোগ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার কামরুল ইসলাম বলেন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা। ঢাকায় যেমন নিরাপত্তাব্যবস্থা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়, তেমনি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোতেও সেই মান বজায় রাখা উচিত।
প্রতিদিন কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে একাধিক ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রীরা আসেন এই সমুদ্র শহরে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এমন ঝুঁঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি থাকায় নিরাপত্তা নিয়ে যাত্রীদের উদ্বেগ বাড়ছে। অনেক যাত্রী সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, অবতরণের সময় রানওয়েতে কুকুর বিচরণের ঘটনায় ভয় পেয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই সমস্যা সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সীমানা প্রাচীর সম্পূর্ণ মেরামত ও ছিদ্র বন্ধ করা, নিয়মিত বার্ড শুটার টিম মোতায়েন এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় আশপাশের এলাকায় প্রাণী নিয়ন্ত্রণ অভিযান চালানো দরকার। রাতের বেলা রানওয়ে পর্যবেক্ষণ বাড়ানোও জরুরি।