বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে প্রশাসন ক্যাডার বহু বছর ধরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও ক্ষমতাশালী শাখা। বিসিএস পরীক্ষার শীর্ষ প্রার্থীদের সাধারণত এটিই পছন্দসই। অথচ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, বাণিজ্য, শুল্কসহ ২৬টি ক্যাডার থাকলেও নীতি প্রণয়ন ও প্রশাসনিক শীর্ষ পদে বিশেষায়িত ক্যাডাররা বারবার উপেক্ষিত হচ্ছেন। প্রশাসন ক্যাডারের একচেটিয়া অবস্থান শুধু ক্ষমতার প্রশ্ন নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোকে একমুখী করে তুলছে। এ সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে বিশেষজ্ঞদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ক্রমশই উপেক্ষিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসন ক্যাডারের প্রভাবশালী হয়ে ওঠার কারণগুলোর মধ্যে মাঠপর্যায়ে ইউএনও বা ডিসি হয়ে সরাসরি প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, দ্রুত পদোন্নতি, সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নিয়োগের সুযোগ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রতিনিধিত্বের অবারিত সুযোগ। সাধারণ মানুষের চোখে ডিসি মানেই সরকার- এই ধারণা তাদের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।
সাবেক সচিব ড. মাহবুব হাসান এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র এখনও ‘জেনারেলিস্ট’ প্রশাসকের হাতে গড়া। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকায় বিশেষজ্ঞরা প্রান্তিক থেকে যায়। এই সংস্কৃতি ভাঙা না গেলে নীতি প্রণয়নে একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি চলতেই থাকবে।
স্বাস্থ্য ক্যাডারের এক সিভিল সার্জন বলেন, আমরা চিকিৎসক হয়ে মাঠে জীবন বাঁচাই, হাসপাতালে সেবা দিই। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। ফলে যেসব নীতি বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না, তা আমাদের মেনে চলতে হয়।
শিক্ষা ক্যাডারের এক অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা সরাসরি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখি নীতিনির্ধারণ করছেন এমন কর্মকর্তা, যিনি কখনও ক্লাস নেননি। শিক্ষার বিষয় এবং এর বাধাগুলো সম্পর্কে তিনি ততটা ওয়াকিবহাল নন। এমন অবস্থায় প্রণীত নীতিমালা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না।
প্রকৌশল ক্যাডারের এক নির্বাহী প্রকৌশলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা সেতু, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো অবকাঠামো নির্মাণে জড়িত। কিন্তু প্রকল্পের টেন্ডার অনুমোদন বা বাজেট বণ্টনের শেষ সিদ্ধান্ত আসে প্রশাসন ক্যাডার থেকে। এতে প্রকৌশলগত বিষয়গুলো গৌণ হয়ে পড়ে।
বাণিজ্য ও শুল্ক ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজস্ব সংগ্রহে আমরা মাঠে কাজ করি, ব্যবসায়ীদের সমস্যার সমাধান করি। কিন্তু বাজেট নীতিতে কোনো ভূমিকা নেই। ফলে বাস্তব রাজস্ব সংকট অনেক সময় উপেক্ষিত হয়।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সচিব পর্যায়ে বর্তমানে প্রায় ৭৫ শতাংশই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রকৌশল, বাণিজ্যসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়েও সচিবের আসনে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাই নিয়োজিত। এতে বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা নীতি প্রণয়নে প্রভাব ফেলতে পারে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. মোরশেদুল ইসলাম বলেন, নীতিনির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের বাদ দেওয়ার সংস্কৃতি প্রশাসনিক দক্ষতার ঘাটতি তৈরি করছে। স্বাস্থ্যনীতি ডাক্তার ছাড়া, শিক্ষানীতি শিক্ষক ছাড়া, প্রকৌশলনীতি ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া প্রণয়ন করলে তা কাগজে ভালো দেখালেও বাস্তবে সফল হয় না।
সরকারের ওপর প্রভাব উল্লেখ করে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, বাস্তব ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা ছাড়া নীতি প্রণয়ন হয়। এর ফলে সেক্টরভিত্তিক দুর্বলতা থেকে যায়। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি বা বাণিজ্যে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে তৈরি হয় ব্যুরোক্রেটিক একচ্ছত্রতা। প্রশাসন ক্যাডারের এমন আধিপত্যে অন্য ক্যাডারের মধ্যে হতাশা তৈরি করে, যা কর্মদক্ষতায় প্রভাব ফেলে। এমনকি মেধা পাচার, মানে অনেক বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা সুযোগ না পেয়ে বিদেশমুখী হন।
আন্তঃক্যাডার সুষম মর্যাদার সমাধান কোন পথে- এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক জনপ্রশাসন ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. এশতেহাম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের প্রশাসনে ‘জেনারেলিস্ট’ আধিপত্য কমাতে হলে বিশেষজ্ঞদের নীতিনির্ধারণে আনতে হবে। অন্যথায় আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি খাত অগ্রসর হতে পারবে না। তিনি বলেন, এ জন্য কিছু গুচ্ছভিত্তিক উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন- মন্ত্রণালয়ভিত্তিক পদ সংরক্ষণ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিকিৎসক, প্রকৌশল মন্ত্রণালয়ে ইঞ্জিনিয়ার- এভাবে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সাজাতে হবে। প্রশাসনিক দক্ষতা থাকলেও সংশ্লিষ্ট সেক্টরের অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়ে পদোন্নতির ব্যবস্থা প্রণীত হওয়া আবশ্যক। নীতি প্রণয়নে বিশেষায়িত ক্যাডারদের প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং থাকা দরকার। নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রশাসন ও বিশেষায়িত ক্যাডার যৌথভাবে সচিবালয়ের দায়িত্ব পালন করবে। সর্বোপরি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
সাবেক সচিব ড. মাহবুব হাসান বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যোগ্য নন- এ কথা বলা যাবে না। তবে যে জায়গায় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের অভিজ্ঞতা অপরিহার্য, সেখানে প্রশাসনিক আধিপত্য যুক্তিসঙ্গত নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সব ক্যাডার পদ সুষম মর্যাদা তৈরি অনেকটা চ্যালেঞ্জের। যেমন- প্রশাসন ক্যাডারের রেজিস্ট্যান্স, দীর্ঘদিনের ক্ষমতাধর অবস্থান থেকে সরে আসতে তারা অনিচ্ছুক। সরকারও অনেক সময় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা পছন্দ করে।
অ্যাডমিন বনাম নন-অ্যাডমিন বিভাজন প্রশাসনিক সংস্কারকে কঠিন করে তোলে। বিদ্যমান বিধিমালা ও সার্ভিস রুল পরিবর্তন ছাড়া কাঠামোগত পরিবর্তনও সহজ নয়।
বাংলাদেশের প্রশাসন এখনও এককেন্দ্রিক ও ক্ষমতানির্ভর উল্লেখ করে ড. এশতেহাম চৌধুরী বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের জনপ্রিয়তা এর কাঠামোগত সুবিধা থেকে এসেছে। সেই বাস্তবতায় অন্য সব ক্যাডারের মধ্যে ক্ষোভ, বঞ্চনা ও হতাশা তৈরি করছে। নীতি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের অনুপস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখন সময় এসেছে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার, যেখানে প্রশাসন ক্যাডার ও বিশেষায়িত ক্যাডার উভয়েকেই সমমান গুরুত্ব বিবেচনায় নিতে হবে। তাহলেই সরকারের নীতিমালা হবে বাস্তবমুখী, টেকসই এবং জনগণের কল্যাণে কার্যকর।