সোমবার, ০৩:১৩ অপরাহ্ন, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

ঘাত-প্রতিঘাতের ৪৭ বছর

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ৮ বার পঠিত

জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলনের কথা সবার নিশ্চয়ই জানা। ইঁদুরের উৎপাত থেকে শহরটির মানুষকে মুক্তি দিতে যেখানে একজন বাঁশিওয়ালার আবির্ভাব ঘটেছিল। যিনি তার বাঁশির মোহিনী শক্তিতে সব ইঁদুর সাগরে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তার বাঁশির সুর এতটাই জাদুকরী ছিল। কখনো কখনো রাজনৈতিক দলকেও মানুষের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কেননা রাজনৈতিক দল গণমানুষের মুখপাত্র। আর কোনো দল যখন গণমানুষকে এক সুতায় গেঁথে ফেলে, একই নীতি ও আদর্শে মোহমুগ্ধ করতে সক্ষম হয় তখন সে দলটি হয়ে ওঠে অনেক দেহের একটি প্রাণ। সে হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে রাজনীতির হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা বললে অত্যুক্তি হয় না।

চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষের দীর্ঘ লড়াই আর সীমাহীন ত্যাগ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করেছে। জনরোষ থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে গেছেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। শুধু বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে তার সরকারের এমন পলায়ন বিরল। আওয়ামী লীগের এ পলায়ন তাদের কৃতকর্মকে জনতার সামনে অত্যন্ত খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করেছে। দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করেছে, বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর চালানো নির্যাতন-নিপীড়নের।

অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করে রাখা হাসিনা সরকার চেয়েছিল এ দেশ থেকে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। কিন্তু পারেনি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের সাধারণ কর্মী তাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, প্রেম ও ত্যাগের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছে তাদের প্রাণপ্রিয় দলকে। যেই বিএনপির যাত্রা শুরু হয়েছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর, একটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। সেনা ব্যারাকে সৃষ্টি হলেও দলটি শুরু থেকেই ছিল হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ভূমিকায়। এখানে সব দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশার মানুষের সন্নিবেশ ঘটেছিল খুব অল্প সময়েই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দলটি সীমাহীন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটি সুদীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছে। আজ ১ সেপ্টেম্বর দলটির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনীতি গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় গ্রন্থের ফ্ল্যাপের অংশেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। তার মতে, ‘বিএনপির জন্ম সেনাছাউনিতে, একজন সেনানায়কের হাতে, যখন তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। এ ধরনের রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়লে সাধারণত হারিয়ে যায়। বিএনপি এদিক থেকে ব্যতিক্রম। দলটি শুধু টিকেই যায়নি, ভোটের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দেশে গণতন্ত্র আছে কি না, বিএনপিতেও গণতন্ত্রের চর্চা হয় কি না, তা নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলা যায়। কিন্তু দলটি দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, এটা অস্বীকার করার জো নেই।’

১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত করে ১৯৫৩ সালে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবহিনীতে। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। সামরিক বাহিনীতে তার ভূমিকা সবসময়ই ছিল বীরোচিত, যা তাকে তার পেশাগত পরিমণ্ডলে শ্রেষ্ঠতর মর্যাদায় ভূষিত করে থাকে। সাহসী রণকৌশল ও অসীম বীরত্বের প্রমাণস্বরূপ হিলাল-ই-জুরাত এবং তামঘা-ই-জুরাত পদকও লাভ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে মেজর হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পরবর্তীকালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে নেতৃত্ব প্রদান করেন।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শ্রেষ্ঠত্বের ভূমিকার বিষয়টি সর্বজন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার ঘোষণা, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দিশেহারা জাতিকে সঠিক পথ দেখানো এবং সশস্ত্র নেতৃত্বের কারণে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ খেতাব বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। পেশাগত জীবনে তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রেখে গেছেন।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। পরে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৯ দিনের মাথায় একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯ দফা ঘোষণা করেন—রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, জনগণ, আইনের শাসন, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, ধর্মব্যবস্থা, মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতি সবকিছুর সমন্বয়ে একটা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উন্নত মডেল তত্ত্ব।

১৯ দফা ছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দেওয়া রাষ্ট্রের মুক্তির দিকনির্দেশনাবলি। এক কথায় বলা যেতে পারে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগ ফিরিয়ে আনেন এই ১৯ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে। তিনি ১৯ দফাতে যেমন শাসনতন্ত্রের মূলনীতি গণতন্ত্রের পথ দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনি সমাজতন্ত্রের ভালো দিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের কথাও বলেছেন। তিনি সমাজব্যবস্থার সব উত্তম দিকের সমন্বয়ে একটা স্বাধীন, অখণ্ড ও সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের স্বপ্নের বাস্তবিক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। এই ১৯ দফায় রাষ্ট্রকে তিনি যেমন সমসাময়িক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, ঠিক তেমনই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের রাষ্ট্রের পথ দেখিয়েছেন। জিয়াউর রহমান তার ওই তত্ত্বে আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের জন্য নিরক্ষরতামুক্ত শিক্ষিত জাতির কথা বলেছেন। একটি দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ ছিল তার সেই ১৯ দফায়।

বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে জিয়াউর রহমান যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, বিশ্বে দ্রুত অগ্রসরমাণ দেশ হিসেবে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অংশ হিসেবে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারান বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এই রাষ্ট্রনায়ক।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ১৯৮২ সালে দল, দেশ ও গণতন্ত্রের অপরিহার্য প্রয়োজনে দলের হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী খালেদা জিয়া। সাধারণ গৃহবধূ থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। সে সময় বিএনপি অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সংকট মোকাবিলায় অনেকটা বেসামাল ছিল। তবে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্ব ও সীমাহীন ধৈর্য এবং প্রজ্ঞা দিয়ে দলটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান প্রবহমান নদীর মতো। সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি পরিচিতি লাভ করেন ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে।

এ বিষয়ে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় বইয়ের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতার

বলয়ের ভেতরে থেকে বিএনপি তৈরি করলেও পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে সেটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সেভাবে এটি রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান, কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া।’

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়ান-ইলেভেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একদিকে বিএনপিকে নিঃশেষ করার ষড়যন্ত্র অন্যদিকে দেশে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক আয়োজন শুরু হয়। নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয় আপসহীন, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির আশ্রয়স্থল খালেদা জিয়াকে। আর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমানকে করা হয় নির্বাসিত। সেই থেকে একের পর এক ষড়যন্ত্র বিএনপিকে ক্ষত-বিক্ষত করার চেষ্টা করেছে।

বিএনপিকে নেতৃত্বহীন করতে দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে ফরমায়েশি রায়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার তাকে অন্যায়ভাবে আটক রাখে বহু বছর। দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মীকে অসংখ্য মামলায় ফাঁসানো হয়। হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে পড়েন দলটির শীর্ষ নেতারাও। স্বৈরশাসক হাসিনা মনে করেছিলেন এভাবে হামলা-মামলা আর গুম-খুনের মাধ্যমে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবেন। কিন্তু সেটি হয়নি বরং দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আঘাতে আঘাতে হয়েছে আরও পরিণত, জনপ্রিয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সব ষড়যন্ত্র-কূটকৌশল মোকাবিলা করে বিএনপিকে রেখেছিলেন ঐক্যবদ্ধ।

তারেক রহমানের নেতৃত্বে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে বিএনপিতে। গণমানুষের মুখপাত্র হিসেবে যেই দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিলম সেই দলটি আজ পৌঁছে গেছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি কানায় কানায়। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে তাই এই দলটির দায় ও দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। যে কারণে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিক গবেষণা করছেন। দলীয় কর্মী থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রচার ও প্রসার এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় বিএনপির সুচিন্তিত প্রতিশ্রুতি এ দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেছে। সেদিন খুবই সন্নিকটে যেদিন বাংলাদেশ ফিরে যাবে তার গণতান্ত্রিক আবহে। যার নেতৃত্ব দেবে শহীদ জিয়ার হাতে গড়া দল বিএনপি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে দলটির জন্য থাকল অফুরন্ত শুভকামনা।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক

জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com