কে পি শর্মা অলি যখন হেলিকপ্টারে করে পালাচ্ছিলেন; পাবলিকের দাবড়ানি খাওয়া মন্ত্রীদের যখন সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে ‘নিরাপদ জায়গায়’ নিয়ে যাচ্ছিল; গুলিতে নিহত আন্দোলনকারীদের স্বজন-সহযোদ্ধারা যখন প্রচণ্ড আক্রোশে এমপি-মন্ত্রী-আমলাদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছিলেন; ক্ষমতাচ্যুত সরকারের লোকজনের পালানো ঠেকাতে যখন কাঠমান্ডু বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর আসছিল; তখন মাথার মধ্যে শুনতে পাচ্ছিলাম ‘শূন্য-প্রজন্মের’ আইকনিক ধমক—‘ডোন্ট মেস উইথ জেন-জি’।
সোজা বাংলায়—‘খবরদার! জেন-জির সঙ্গে পাঙ্গা নিতে যাইয়ো না।’
অলির সরকার সেই কাজটাই করেছে। তারা জেন-জি খেপিয়ে ধরা খেয়েছে। এই জেন-জি চলে স্মার্ট গতিতে। তারা সোজা কথা সোজাভাবে এবং অবশ্যই অতি সংক্ষেপে বলতে ও শুনতে পছন্দ করে।
স্মার্টফোনেই তারা কাজের বেশির ভাগ সেরে ফেলে। যে কথাটা বলতে তিনটি বাক্য লাগে, তা তারা বলে তিন শব্দে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন অক্ষরে।
পানির অপর নাম যেমন জীবন, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তি; বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জেন-জির শ্বাসপ্রশ্বাস।
এই জিনিস অলির সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব আর এক্স (আগের টুইটার) এক রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
আমাদের এখানে আমলা-মন্ত্রী-এমপিদের অনেকের ছেলেমেয়ে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনে, কিংবা ১০ লাখ টাকার লেহেঙ্গা পরে, কিংবা ১০ কোটি টাকার গাড়ি কিনে দেখনদারি সেলফি দেওয়ার পর ভাইরাল হয়েছিলেন।
তার জেরে কাউকে কাউকে কঠিন বিপদে পড়তে হয়েছিল। ঠিক সেই কায়দায় নেপালে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের ছেলেমেয়ে নানা ধরনের বিলাসবহুল ফুর্তিফার্তার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিয়েছিলেন।
অনেকের দুর্নীতির খবর সংবাদমাধ্যমে চলে এসেছিল। সেসব খবর ও ছবি বঞ্চনার আগুনে পুড়তে থাকা জেন-জিকে খেপিয়ে তুলেছিল। রাজনীতিকদের সন্তানদের বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের পোশাক-গয়না প্রদর্শনের ছবি তাঁরা ভাইরাল করেছেন।
এই ‘আলালের ঘরের দুলাল’দের নাম দেওয়া হয়েছে, ‘নেপো কিডস’। #NepoKids এবং #PoliticiansNepoBabyNepal হ্যাশট্যাগে ‘নেপো কিডস’দের চৌদ্দগুষ্টির কীর্তিকলাপের ফিরিস্তি তুলে ধরা হচ্ছিল।
সরকার যখন দেখল রাজনীতিকদের ধুতি খুলে যাচ্ছে, তখন ফট করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, এক্স—সব বন্ধ করে দেওয়া হলো। তার মানে, যে মাধ্যমগুলো জেন-জির শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো, সেগুলো সরকার দুম করে বন্ধ করে দিয়েছিল।
ধারণা করি, এই অঞ্চলের ‘বুড়িয়ে যাওয়া’ রাজনীতিকদের প্রধান সমস্যা হলো, তাঁরা বুঝতে পারেন না, জেন-জি দুবেলা না খেয়ে থাকতে রাজি, কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা তারা সহ্য করতে পারে না।
ইন্টারনেট বন্ধ করা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া মানে সরাসরি তাদের গলা টিপে ধরা। এতে তাদের দমবন্ধের অনুভূতি হয়। এতে তারা চরমভাবে অপমান বোধ করে।
সরকারের লোকজন দুর্নীতি করবে, আর সেই দুর্নীতির কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখে বা ট্রল করে হালকা হওয়ার সুযোগও থাকবে না—এটা জেন-জি মানতে পারে না।
তাদের এই মানতে না–পারাটাই সরকার পতনের পেট্রলে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি হয়েছে।
সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছিল, এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণামূলক বক্তব্য ও ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছিল, তাই এগুলো বন্ধ করা হয়েছে।
জেন-জি ঠিকই বুঝেছে, ‘ইন্টারনেট এমনি এমনি বন্ধ হয়ে গেছে’র মতো এটাও একটা ‘চালাকি মার্কা’ কথা। আর এই প্রজন্মের সবচেয়ে অপছন্দ হলো সোজা না বলে ঘুরিয়ে বলা কথা বা চালাকি করা কথা। এতে তারা প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছে।
সেই বিরক্তি থেকে তারা রাস্তায় নেমেছে। বিক্ষোভ করেছে। তাদের এই বিক্ষোভে নিশ্চয়ই সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর সমর্থন ছিল। কিন্তু কেউ সামনে আসেনি। পেছন থেকে আন্দোলনে সহায়তা করেছে। গত বছর ঠিক এই জিনিস আমরা বাংলাদেশে দেখেছি।
এই তরুণেরা খুব সচেতনভাবে, অর্থাৎ মেটিকিউলাস ডিজাইনের অংশ হিসেবে দলীয় সীমারেখা প্রত্যাখ্যান করে একটি বিবেকনির্ভর আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তাতেই সরকার পড়ে গেছে। অনেকেই বলছেন, দুর্নীতিবাজ অলির সরকার পালানোয় উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এখন রাজতন্ত্রপন্থী এবং হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় চলে যেতে পারে। নতুন করে সেখানে বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হতে পারে।
গত বছর আমাদের দেশে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন চলছিল, তখন আন্দোলনকারীদের মধ্যে কোন নেতার কী নাম, কী পরিচয়; তা নিয়ে জেন-জিকে অতটা মাথা ঘামাতে দেখিনি।
নেপালেও একই ঘটনা দেখা গেছে। সরকার ফেলে দেওয়ার মতো এত বড় কাণ্ড তারা ঘটিয়ে ফেলল, কিন্তু কেউ ঠিকমতো জানে না, এই আন্দোলনের মূল নেতা কে। আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্ত পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা ছিল ‘নামহীন, গৃহহীন…দীপ্তিহীন, কীর্তিহীন’। শুধু এইটুকু সবাই জেনেছে, তারা ‘জেন-জি’।
কোনো দল বা ব্যক্তি এই আন্দোলনের মালিকানা দাবি করেনি। এটা ছিল সচেতন কৌশল। কারণ, এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মতো নেপালেও রাজনৈতিক দলগুলোকে দুর্নীতি আর লুটেপুটে খাওয়ার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখা হয়।
এ কারণে তারা আন্দোলনটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দলের নাম–গন্ধ রাখেনি। খুব পরিচিত কেউ আন্দোলনটির নেতৃত্বে ছিলেন না।
এই তরুণেরা খুব সচেতনভাবে, অর্থাৎ মেটিকিউলাস ডিজাইনের অংশ হিসেবে দলীয় সীমারেখা প্রত্যাখ্যান করে একটি বিবেকনির্ভর আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তাতেই সরকার পড়ে গেছে।
অনেকেই বলছেন, দুর্নীতিবাজ অলির সরকার পালানোয় উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এখন রাজতন্ত্রপন্থী ও হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় চলে যেতে পারে। নতুন করে সেখানে বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হতে পারে।
তবে সুখের কথা, সামনে যা-ই হোক, যারাই ক্ষমতায় যাক—এই অভ্যুত্থান তাদের সামনে অন্তত সেই কড়া ধমক হাজির করেছে—‘ডোন্ট মেস উইথ জেন-জি।’