দুই ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের দেশে যুদ্ধ চলছে। সারা বিশ্বে সেই যুদ্ধ নিয়ে কত আহা-উহু, ট্রাম্প যাচ্ছেন যুদ্ধ মেটাতে। আমাদের মোদিজিও জানা গেল জেলেনস্কির সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছেন। কিন্তু এ মহামানবদের কেউ ফিলিস্তিনের গাজা নিয়ে কোনো কথা বলছেন না। মরছে তো মরুক, মরছে তো মুসলমান। এটাই কি তাহলে নতুন বিশ্বদর্শন? মজার কথা হলো, কেবল ভারত বা আমেরিকাই কথা বলছে না, তা নয়। ইসরাইল ও পাকিস্তান ট্রাম্প সাহেবকে নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করেছে। সৌদি আরবও চুটিয়ে ব্যবসা করছে। মুসলমান যে মরছে, তা নিয়ে তারা চিন্তিত নয়। কী চলছে গাজায়? ২৮ বছর বয়সি আনাস আল শরিফ গাজার অন্যতম পরিচিত মুখ ছিলেন। আলজাজিরার সাংবাদিক হিসাবে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরছিলেন। তার বাবাও ডিসেম্বর ২০২৩ সালে এক ইসরাইলি হামলায় মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু দুই সন্তানের পিতা আনাস উত্তর গাজা ছেড়ে যেতে রাজি হননি। তিনি এক সৎ সাংবাদিক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সত্যি বলার ঝুঁকি অনেক। গাজা শহরের আলসিফা হাসপাতালের বাইরে সাংবাদিকদের জন্য তৈরি করা একটা তাঁবুতে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় আনাস এবং তার সঙ্গে আরও চার সহকর্মী মোহাম্মদ কারেকেই, ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নওফাল এবং মোমেন আলিয়া নিহত হন। মৃত্যুর আগে আনাস একটা বার্তা লিখে রেখেছিলেন, যা তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তাতে লেখা ছিল : গাজাকে ভুলে যেও না। ডোন্ট ফরগেট গাজা।
আনাসের এ মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা একটা বড় নকশার অংশ। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) বলছে, ইসরাইল সাংবাদিকদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে তাদের হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার এক নির্দিষ্ট ধাঁচ অনুসরণ করেছে। ইসরাইল সেনাবাহিনী দাবি করেছিল, আনাস হামাসের একজন কমান্ডার ছিলেন; কিন্তু তার পক্ষে প্রমাণ নেই একটাও। ইসরাইল খুন করেছে আনাসকে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো, যারা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে, তারা কেন চুপ? গাজায় যা ঘটছে তাকে শুধু যুদ্ধ বললে ভুল হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর জানাচ্ছে, ২০২৫ সালে ১৪শ’য়ের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে, যখন তারা খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) বলছে, এ ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলো আসলে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং মৃত্যুফাঁদ। এ যুদ্ধের সবচেয়ে করুণ শিকার শিশুরা। ইউনিসেফ জানাচ্ছে, গাজার প্রতি তিনজন মানুষের মধ্যে একজন এমন অবস্থায় আছেন, যার দিনের পর দিন কোনো খাবারই জুটছে না। পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় ৩ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
একটা সমাজের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়া মানে সেই সমাজের বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও মরে যাওয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এমএসএফের মতে, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। সেখানকার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে ৯৪ শতাংশ হয় ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ধ্বংস হয়ে গেছে। যে কয়েকটি হাসপাতাল এখনো চালু আছে, সেগুলো প্রতিদিন হতাহতের ঘটনা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। হাসপাতালের করিডরগুলো রোগীতে ঠাসা। জীবনদায়ী ওষুধ, চিকিৎসার সরঞ্জাম নেই, নেই অ্যান্টিবায়োটিক, ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় এক্সটার্নাল ফিক্সচারের মতো সাধারণ জিনিসপত্রও নেই। প্রায় ১৫ হাজার মানুষের জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য গাজার বাইরে যাওয়া প্রয়োজন; কিন্তু সেই পথ বন্ধ।
সমাজকে মেথডিক্যালভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য এটা একটা প্রক্রিয়া, একটা প্ল্যানিং। মানুষের বাড়িঘরের ৯২ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত, স্কুল-কলেজ ৯৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত, চাষের জমি ৮৬ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত। পানি, স্যানিটেশনব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই যখন অবস্থা, তখন সেটা আর যুদ্ধ থাকে না। একে বলা হয় আরবিসাইড, নগরের পরিকল্পিত হত্যা। এক নগরকে খুন করা হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য একটা জনগোষ্ঠীকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে অস্তিত্বকে মুছে ফেলা।
এটাই গণহত্যা। হ্যাঁ, গণহত্যা চলছে অথচ দুনিয়ার যুদ্ধ থামিয়ে দিচ্ছেন বলে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নোবেল পুরস্কারের সুপারিশ করছে পাকিস্তান-ইসরাইল। ইসরাইলকে আবার পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে ভারত। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি অঞ্চলসংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রান্সিসকা আলবানিস তার রিপোর্টে স্পষ্ট বলছেন, বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ইসরাইল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। শুধু জাতিসংঘই নয়, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এমনকি ইসরাইলের নিজস্ব মানবাধিকার সংস্থা বিটসলেম, তারাও ইসরাইলের কাজকর্মকে গণহত্যাই বলছে। এ আইনি বিশ্লেষণগুলো থেকে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার-আন্তর্জাতিক আদালত থেকে শুরু করে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ, বিশ্বের প্রধান মানবাধিকার সংস্থাগুলো গাজার পরিস্থিতিকে গণহত্যাই বলছে। সবাই জানে, কিন্তু তারপরও এ ধ্বংসলীলা বন্ধ হচ্ছে না কেন? এর কারণ হলো, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে এ মৃত্যু নিয়ে কোনো আবেগ, মায়া, মমতা, মানবিকতা কিছুই নেই।
আসলে এর পেছনে আছে এক সক্রিয় ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, যা কয়েকটি শক্তিমান দেশের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সবচেয়ে বড় সমর্থক ও রক্ষাকবচ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইসরাইল আমেরিকার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি সাহায্য পেয়েছে। ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে কমপক্ষে ২২.৭৬ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা এবং খরচ জুগিয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যখনই গাজায় যুদ্ধবিরতি আনার প্রস্তাবনা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়ে সেটাকে আটকে দিচ্ছে। আমেরিকার সরকারি অবস্থান হলো, ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ আয়রন ক্ল্যান্ড সমর্থন ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক চাপ থেকে কার্যত মুক্তি দিয়ে দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসাবে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলেছে অতীতে। ইতিহাস তা-ই বলছে। কিন্তু মোদি জমানাতে এ অবস্থানে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। আমরা জানি, বর্তমানে ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ রয়েছে। ইসরাইল এখন রাশিয়ার পর ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী। ইউরোপীয় ইউনিয়নও সামগ্রিকভাবে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২৪ সালে তাদের মধ্যে পণ্যের বাণিজ্য হয়েছে প্রায় ৪২.৬ বিলিয়ন ইউরো। জার্মানি, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের নিরাপত্তা, গোয়েন্দা এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা রয়েছে।
অবশ্য ইউরোপের সব দেশ এক নয়। স্পেন, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়ামের মতো ছোট দেশগুলো ইসরাইলের তীব্র সমালোচনা করছে। তারা অস্ত্র বিক্রি বন্ধ রেখেছে এবং ইইউ-ইসরাইল অ্যাসোসিয়েশন এগ্রিমেন্ট পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে, যার অন্যতম শর্ত হলো, মানবাধিকার রক্ষা করা। কিন্তু ইইউতে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব সদস্য দেশের সম্মতির প্রয়োজন হয়। সেখানে জার্মানি-হাঙ্গেরির মতো ইসরাইলের কট্টর মিত্র আছে, কট্টর বন্ধু আছে; তাদের বিরোধিতার কারণে সম্ভব হচ্ছে না।
এর মানে কী দাঁড়াল? সবটাই ওই টাকা। বাণিজ্যের খেলা। মানবিকতা নয়, মৃত্যু নয়, গণহত্যা নয়, এমনকি ধর্মও নয়। মূল বিষয় হলো, বাণিজ্য আর মুনাফা। গাজার ঘটনাগুলো এক আঞ্চলিক সংকট নয়, এটা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার নৈতিক রাজনৈতিক ব্যর্থতার একটা নির্লজ্জ প্রতিচ্ছবি। সাংবাদিক আনাস আলসারিফের মৃত্যু যে প্রশ্নগুলোর জন্ম দিচ্ছে, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখছি, বিশ্বের তথাকথিত নীরবতা আসলে কোনো শূন্যতা নয়। এটা একটা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটা সক্রিয় এবং সশব্দ আস্ফালন। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রধান আঞ্চলিক মিত্রকে রক্ষা করার কৌশলগত বাধ্যবাধকতা থেকে ইসরাইলকে একটা লৌহবর্ম দিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে, ভারতের মতো উদীয়মান শক্তিগুলো তাদের ঐতিহাসিক আদর্শবোধ অবস্থান থেকে সরে এসে নতুন প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্বকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ইউরোপের মতো শক্তিধর জোট, অভ্যন্তরীণ বিভাজন, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং ঐতিহাসিক অপরাধবোধের কারণে কোনো ঐক্যবদ্ধ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। আর আরব বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের একপাশে সরিয়ে রেখে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ হাসিল করতে ব্যস্ত। এটা সম্মিলিত স্বার্থপরতা। এ স্বার্থপরতা গাজার ট্র্যাজেডিকে দীর্ঘায়িত করছে। যারা বলেছিল, হিটলারের সেই হলোকাস্টের পরে আর কখনো এমন গণহত্যা হতে দেওয়া হবে না; সেই তারাই এখন একই কাজ করছে। এটা বিশ্বব্যাপী সেই প্রতিজ্ঞার চরম অবমাননা। এটা শুধু রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গড়ে ওঠা নৈতিক বিশ্বব্যবস্থার সংকট। তবে রাষ্ট্র নীরব থাকলেও মানুষ নীরব নেই। বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন, যা প্রমাণ করে, বিশ্ব বিবেক এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি। আনাস আল শরিফের শেষ আর্তি ছিল : গাজাকে ভুলে যেও না। ডোন্ট ফরগেট গাজা।
ভুলে যাওয়া এক রাজনৈতিক অপরাধ। ভুলে যাওয়া এক নৈতিক অপরাধ; যা অত্যাচারীকে তার অত্যাচার চালিয়ে যেতে সাহায্য করে। তবে মনে রাখা ও প্রতিবাদ করাও এক রাজনৈতিক প্রতিরোধ। এখন প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষের এ সম্মিলিত কণ্ঠস্বর কি রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের রাজনীতিকে ছাপিয়ে উঠতে পারবে? আমরা কি বোঝাতে পারব, আমাদের দেশের শীর্ষে বসে থাকা প্রধানমন্ত্রীকে যে, এই কাজ করবেন না। আমেরিকাবাসী কি গাজায় গণহত্যা বন্ধে ট্রাম্প প্রশাসনকে বাধ্য করতে পারবে? এর উত্তরের ওপরে নির্ভর করছে সবকিছু। শুধু গাজার নয়, সব মানবজাতির ভবিষ্যৎ।
বাংলা বাজার ইউটিউব চ্যানেলের সৌজন্যে
অনিকেত চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার