রবিবার, ০৩:১২ অপরাহ্ন, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩০শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

খোদ অ্যাম্বুলেন্সেরই মুমূর্ষু দশা

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ৪ বার পঠিত

মুমূর্ষু রোগী ও লাশ বহন করে অ্যাম্বুলেন্স। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে খোদ এ বাহনেরই মুমূর্ষু দশা। ফিটনেসবিহীন মাইক্রোবাস ও পিকআপ কেটে তৈরি হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বাহন থেকে অ্যাম্বুলেন্স তৈরির বেশ কিছু শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে, যা প্রায় অপ্রতিরোধ্য। পাশাপাশি রোগী ও তার স্বজনদের যারপরনাই হয়রানিও করা হচ্ছে অহরহই। উপরন্তু অ্যাম্বুলেন্সের সেবার মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। কারণ অ্যাম্বুলেন্স হওয়ার কথা এমন গাড়ির, যা সবচেয়ে দ্রুতগামী ও অত্যাধুনিক। শুধু সম্পূর্ণ যুক্ত (কমপ্লিট বিল্ড আপ-সিবিইউ) অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানিকৃত ডুয়েল এয়ারকন্ডিশন-বিশিষ্ট গাড়ি হওয়ার কথা। বাস্তবতা হচ্ছে মাইক্রোবাস/মাইক্রোভ্যান-জাতীয় গাড়িকে স্থানীয়ভাবে রূপান্তরের মাধ্যমে করে তোলা হয় অ্যাম্বুলেন্স, যার ভেতরে রোগীর প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের অনেক উপাদানই থাকছে না।

এমন বাস্তবতায় অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস নীতিমালা-২০২৫ এর খসড়া প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এরই মধ্যে প্রস্তাবটি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জমান আমাদের সময়কে বলেন, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে হয়রানি দেশজুড়ে। এর প্রতিকার জরুরি। নীতিমালা প্রস্তুত হয়ে থাকলে, তা যেন কেতাবি না হয়। এ দেশে কাগজে-কলমে বহু নীতিমালা আছে, যেগুলোর বাস্তবায়ন নেই। আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখানোর অপসংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। বিআরটিএ বরারবই জনবলের অভাবের দোহাই দেয়। এরও উত্তরণ প্রয়োজন।

ড. হাদিউজ্জামান আরও বলেন, ব্যক্তি-মালিকানায় কোনোভাবে অ্যাম্বুলেন্স চলতে পারে না। এ জন্য দরকার বিশ^ব্যাপী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সার্ভিস। বিশে^র অন্যান্য দেশে চলা অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে আমাদের অ্যাম্বুলেন্সের কোনো মিল নেই। এখানে অ্যাম্বুলেন্স সেবার নামে অনন্যোপায় মানুষকে জিম্মি করা হয়। প্রায়ই সিন্ডিকেটের খপ্পড়ে পড়ে রোগীসহ স্বজনদের পোহাতে হয় দুর্ভোগ।

জানা গেছে, বিআরটিএর প্রস্তুতকৃত নীতিমালায় বলা আছেÑ ব্যক্তি-মালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা নিষেধ। কোনো ‘ব্যক্তি’ অ্যাম্বুলেন্সের মালিক হতে পারবেন না। ব্যক্তির মাধ্যমে পরিচালিত বাহনে অসুস্থ রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকে না। মানহীন এসব বাহনে রোগী কাক্সিক্ষত সেবা পান না। এ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সিন্ডিকেটের কারণে রোগীর জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে।

এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত গত আগস্টে শরীয়তপুরের হৃদয়বিদারক ঘটনাটি। মুমূর্ষু নবজাতক বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সকে আটকে দেয় চালকদের সিন্ডিকেট, ফলে পথেই মৃত্যু হয় শিশুটির।

নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানিকৃত গাড়ির মাধ্যমে কেবল এ সেবাই দেওয়া হবে। গাড়িতে রোগীকে শোয়ানোর জন্য থাকতে হবে স্ট্রেচার। এ ছাড়া কমপক্ষে একজন প্যারামেডিকস (নার্স/ মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট) এবং রোগীর একজন অ্যাটেনডেন্ট বসার উপযুক্ত আসন থাকতে হবে। মেডিক্যাল যন্ত্রাংশ এবং ব্যবহারযোগ্য মেডিক্যাল পণ্য যেমনÑ অক্সিজেন সিলিন্ডার, নেবুলাইজার মেশিন, ইনট্রাভেনাস ইনজেকশন স্ট্যান্ড, ফাস্ট এইড বক্স, ট্রমা প্যাডস ইত্যাদি রাখা বাঞ্ছনীয়। বাহনে নিরাপত্তা বেল্টযুক্ত স্ট্রেচার থাকবে, যার পরিমাপ হবে ন্যূনতম ১৯০ গুণ ৫০ গুণ ৯০ সেন্টিমিটার।

ঝাঁকুনিরোধ সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য এবং ভাঁজ করা যায়- এমন বহনযোগ্য সাবস্ট্রেচার থাকতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সের ছাদের ওপর ঘূর্ণায়মান লাল রঙের বিকন লাইট থাকবে। অনবরত শব্দ তৈরি করতে পারেÑ এমন অ্যামপ্লিফায়ারসহ সাইরেন ও স্পিকার থাকবে। তবে মানমাত্রা নির্ধারিত থাকতে হবে নির্গত শব্দের। থাকতে হবে রিফ্লেকটিভ ট্রায়াঙ্গল। রাখতে হবে ফায়ার এক্সটিংগুইসার। বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে আইসিইউ/সিসিইউ ব্যবস্থা থাকবে। গাড়ির গতিবিধি, অবস্থান জানার জন্য এবং চুরি বা ছিনতাই রোধে থাকতে হবে ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেম।

সরকারি/আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান নিজস্ব সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ পাবে। আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা, করপোরেট বা অন্য প্রতিষ্ঠানের অনুদান হিসেবে পাওয়া গাড়িও রেজিস্ট্রেশন পাবে। বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক প্রাইভেট হিসেবে বহনের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক অ্যাম্বুলেন্সের অনুমোদন পাবে। একটি কোম্পানি কমপক্ষে ১০টি ফ্লিটের অধিকারী হওয়ার সুযোগ পাবে। থাকতে হবে নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা। লিজ বা অপারেটর নিয়োগের মাধ্যমে হস্তান্তরের সুযোগ নেই। থাকবে না পাওয়ার অব অ্যাটর্নির সুযোগ। সেবাগ্রহীতা অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে দ্রুততম সময়ে সাড়া দিতে হবে। অস্বীকৃতি জানানোর সুযোগ নেই। যেসব অ্যাম্বুলেন্স ব্যক্তি মালিকানায় চলছে, সেগুলো তিন বছরের মধ্যে কোম্পানির আওতায় আসতে হবে। মিটার থাকতে হবে কোম্পানিভিত্তিক ভাড়ায় চালিত বাহনে। মহানগরীর মধ্যে প্রথম ২ কিলোমিটার সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা এবং মহানগরীর বাইরে প্রথম ২ কিলোমিটার সর্বোচ্চ ভাড়া ৪০০ টাকা। প্রতি কিলোমিটার বা এর অংশের জন্য ভাড়া ৩৫ টাকা। আইসিইউ ও সিসিইউ সন্নিবেশিত অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ভাড়া মহানগরীর মধ্যে প্রথম ২ কিলোমিটারে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা এবং মহানগরীর বাইরে প্রথম ২ কিলোমিটারের ভাড়া সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার বা তার অংশের জন্য ভাড়া ৬০ টাকা।

অ্যাম্বুলেন্স চালকের জন্য ১১টি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে প্রস্তাবিত নীতিমালায়। এ বাহন চলাচলের সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংরক্ষণের কথাও নির্দিষ্টভাবে বলা আছে। যদিও বিআরটিএর একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে অনেকেই এ আইন ভেঙে অ্যাম্বুলেন্সের মতো জরুরি সেবার অজুহাতে ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

আইন অনুযায়ী, রোগী ও লাশ বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স পরিবহনে যে নিবন্ধন দেওয়া হয়, সেটি সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া হয়। কিন্তু দেশের সর্বত্র এটি ব্যক্তি-মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স চালাতে হলে রোগী শোয়ার স্থায়ী শয্যা (পর্যাপ্ত জায়গা), অক্সিজেন সিলিন্ডার-মাস্ক, মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বসার ব্যবস্থা, স্ট্রেচার ও সাইরেন বসাতে হবে। যাত্রী বহনের আসন বসানো যাবে না। এসব শর্তসাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানকে অ্যাম্বুলেন্সের লাইসেন্স দেওয়া হয়। লাশ বহনেও প্রতিষ্ঠানকে অনুরূপ শর্ত পূরণ করতে হয়। এসব শর্ত ভাঙলে প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে কারণ দর্শাতে বলা হয়। অন্যথায় আর্থিক দণ্ড ও লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, লক্কড়ঝক্কড় অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও মাস্ক নেই। রোগী শোয়ানোর মতো স্রেফ একটি ট্রলি বসানো আছে। সেটিতে যাত্রী টানারও আসন রয়েছে।

অ্যাম্বুলেন্স নিবন্ধন দেওয়ার দায়িত্ব বিআরটিএর। অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন হয় ‘ছ’ সিরিয়ালে। কেবল সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বুলেন্সকেই নিবন্ধন দেওয়া হয়। ব্যক্তিমালিকানার অ্যাম্বুলেন্স চলাচল অবৈধ। কিন্তু দেখা যায়, গ, ‘চ’ ও ‘ঠ’ সিরিয়ালের গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘ঠ’ সিরিয়াল হয় পিকআপের। অর্থাৎ, পিকআপকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করা হয়েছে। ‘গ’ সিরিয়াল প্রাইভেট কারের। ‘চ’ সিরিয়াল মাইক্রোবাসের। কিছু অ্যাম্বুলেন্স দেখা যায় ‘শ’ সিরিয়ালেরও। আসলে এ সিরিয়ালটি রেফ্রিজারেটর ভ্যানের। এ বিষয়ে বিআরটিএ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে- তা জানতে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় বিআরটিএর চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। এমনকি মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তাও পাঠানো হয়। এরপরও তিনি ফোন রিসিভ করেননি এবং কোনো সাড়াও দেননি।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com