পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের চীন সফরে দু’দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি হচ্ছে না, তবে ২০টির মতো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পাশাপাশি কিছু প্রকল্পর উদ্বোধন হতে পারে।
যে সব বিষয়ে সমঝোতা হবে তার কোনো আর্থিক মূল্যের কথা না জানালেও মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এখন ‘দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে’।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এই সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক হবে, যার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রয়োজনের নিরিখে এবং সব শর্ত পূরণ হলে ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়ে বেইজিংয়ের দিক থেকে ঘোষণা আসতে পারে এবং এই ঋণ চীনা মুদ্রায় দেয়ার ওপরই জোর দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
প্রধানমন্ত্রী সোমবার বেইজিংয়ের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর এটি দ্বি-পক্ষীয় স্তরে তার দ্বিতীয় বিদেশ সফর। এর আগে তিনি গত মাসে ভারত সফর করেন।
এছাড়া বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির আগে এই সফরের রাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
শেখ হাসিনা এর আগে ২০১৪ সালে ও ২০১৯ সালে চীন সফর করেন। আর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালে ঢাকা সফরে এসেছিলেন।
বাংলাদেশ সাধারণত বড় বড় প্রকল্প কিংবা অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় চীনের কাছ থেকেই গত দেড় দশক ধরে সহায়তা পেয়ে আসছে এবং বেশিভাগ বড় প্রকল্পের অর্থ যোগানের ক্ষেত্রে এখন চীনকেই বিবেচনা করে থাকে বাংলাদেশ।
অর্থের জন্য চীন কেন গুরুত্বপূর্ণ
গত এক দশক ধরে ছোট বড় নানা প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। চীনের অর্থায়নে চট্টগ্রাম টানেল নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছে চীনা কোম্পানি। প্রায় শেষ হয়েছে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট (এইআই) গত বছর যে ধারণা দিয়েছিল তাতে বাংলাদেশে মোট চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল সাত বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
এছাড়া চীনের কয়েকটি কোম্পানি বিভিন্ন খাতে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের নির্মাণ কার্যাদেশ পেয়ে কাজ সম্পন্ন করেছে কিংবা এখনো করছে।
বাংলাদেশের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও এখন সংসদের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির প্রধান আব্দুল মান্নান বিবিসি বাংলাকে বলেন, চীনের কাছ থেকে আর্থিক বা প্রকল্পগত সহায়তা চাওয়ার কারণ হলো চীন কখন ‘অন্যের ওপর কিছু চাপিয়ে দেয় না’।
তিনি বলেন, ‘চীন উদীয়মান বিশ্ব সেরা অর্থনীতি। এশীয় প্রতিবেশী হিসেবে আমরা আরো বন্ধুত্বের পক্ষে। যে কোনো চুক্তি বা সমঝোতায় বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে। তাই চীনের সাথে বন্ধুত্ব গুরুত্বপূর্ণ।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত রাজনৈতিক যোগাযোগ, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার কারণেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে চীনা সহায়তা চেয়ে থাকে।
‘সুদের হার ও খরচ কম’
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, সুদের হার, শর্ত, প্রযুক্তি ও কম খরচ হবে- এসব চিন্তা করেই বাংলাদেশ প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের সহায়তা প্রত্যাশা করে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত ঋণটা সহজে পাওয়া যায়। অন্য দাতা সংস্থাগুলোর মতো দুই শতাংশ সুদেই ঋণ দেয় চীন। আর কস্ট বেনিফিট বিবেচনায় নিলে যেখান থেকে ঋণ পেলে সুবিধা সেদিকেই তো যাব আমরা। সে জন্যই চীন গুরুত্বপূর্ণ।’
তার মতে, অবকাঠামো উন্নয়ন-সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের প্রযুক্তি বা খরচ অন্য দেশের তুলনায় কম হয়।
তিনি বলেন, ‘তাছাড়া দেখতে হবে অর্থ দেয়ার সক্ষমতা কার আছে। উপকরণের দাম কে কম নিবে। চীনের কাছে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ আছে তা আর কারো কাছে নেই। তাছাড়া চীন এখন অনেক সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। তাদের ঋণের ধরনেও আমরা অভ্যস্ত হয়েছি। সে কারণেই তাদের অফার বাংলাদেশ বিবেচনা করে। তারা প্রযুক্তি ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রেই সক্ষম। আর গুরুত্বপূর্ণ হলো চীন তাদের নিজেদের প্রযুক্তি চাপিয়ে দেয় না। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় তারা বিনিয়োগ করছে যেখানে ঠিকাদার তাদের কিন্তু প্রযুক্তি অন্য দেশের।’
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইডডাটার তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল।
কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন চীনই বাংলাদেশের জন্য একক বৃহত্তম ঋণদাতা দেশ।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে ২৩০ কোটি ডলার ঋণ কিংবা সহায়তা নিয়েছে চীনের কাছ থেকে। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত চার বছরে বাংলাদেশে তিন বিলিয়ন ডলার সহায়তা এসেছে চীন থেকে।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরেও একটি মেট্রোরেল রুট-সহ আরো কয়েকটি রেলওয়ে প্রকল্প এবং কয়েকটি সেতু নির্মাণ বা সংস্কারের বিষয়ে সমঝোতা হবে বলে বাংলাদেশ আশা করছে।
তবে বহুল আলোচিত তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি চীন আলোচনায় নিয়ে এলেও এ নিয়ে আলোচনা হবে।
তিনি মন্তব্য করেন, ‘তবে যেহেতু নদীটি ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী তাই ভারতের প্রস্তাব আগে দেখতে হবে।’
‘প্রকল্প চূড়ান্ত করা সহজ’
অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে- সেগুলোতেও সুদের হার এখন আর কম নয়।
বরং যেহেতু বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ দরকার সেখানে চীনের সাথে দরকষাকষি করে প্রকল্প চূড়ান্ত করা এখন ‘অপেক্ষাকৃত সহজ’ বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, ‘বিশ্ব ব্যাংক কিংবা এডিবির সাথে নেগোসিয়েশনে যত সময় লাগে চীনের ক্ষেত্রে তত সময় লাগে না। বরং সামিট হলে (দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক) এবং সমঝোতা হলে দ্রুত প্রজেক্ট পাশ করবে তারা। বাংলাদেশ আগ্রহী হলে সেটায় অর্থায়নও করবে তারা।’
আবার অনেক সময় দাতাদের ফোকাস এরিয়া থাকে, কিন্তু চীন প্রযুক্তি ও আর্থিকভাবে অবকাঠামো সহযোগিতা করতে আগ্রহী থাকে। একই সাথে বাংলাদেশ যে ধরনের প্রকল্প নিতে চায় সেগুলো চীনের দেয়ার জায়গার সাথে মিলে যায় বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর বিশ্ব ব্যাংক-সহ দাতা সংস্থাগুলোও আগের মতো কম সুদে বা সহজ শর্তে ঋণ দেয় না। অথচ চীন তাদের মুদ্রায় বাণিজ্য করতে চায়। আবার তাদের ব্যবসায়িক জায়গাও আছে বাংলাদেশে।’
তিনি জানান, ‘বাংলাদেশে তাদের বার্ষিক রফতানির পরিমাণ ২২ থেকে ২৩ বিলিয়ন ডলার। নিজের অর্থায়ন বা অন্যের অর্থায়নে চলমান অনেক প্রকল্পে চীনা কোম্পানি কাজ করছে। ফলে তারাও বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে অনেক বেশি আগ্রহী থাকে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেন, বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টিতে বাংলাদেশ এবার বিশেষ গুরুত্ব দেবে।
তবে বাজেটে সহায়তার যে খবর গণমাধ্যমে এসেছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন কোনো প্রস্তাব বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়নি।
সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, চলমান রিজার্ভ সঙ্কট মোকাবেলায় চীনের কাছে বাজেট সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ।
যে সব বিষয়ে সমঝোতা হতে পারে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় দু’দেশের সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে প্রায় ২০টির মতো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে এবং কিছু প্রকল্প উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়া হবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাত, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল ইকোনমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহায়তা, ষষ্ঠ ও নবম বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রফতানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পিপল টু পিপল কানেকটিভিটি প্রভৃতি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে।
সূত্র : বিবিসি