মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সঙ্ঘাতের জেরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে। গোলাগুলির শব্দে আতঙ্ক বেড়েই চলেছে সীমান্তের বাসিন্দাদের মধ্যে। সীমান্তবর্তী অনেকেই ঘর ছেড়েছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।
বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকালে টেকনাফ সীমান্তে গুলি বর্ষণ ও ভারী অস্ত্রের শব্দ শুনতে পায় স্থানীয়রা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জান্তা বাহিনী ও আরকার আর্মির সাথে তুমুল সংঘর্ষ চলমান রয়েছে। এর ফলে ঘুমধুম সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া মর্টারশেলের বিস্ফোরিত অংশ এসে পড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী একটি বাড়ির উঠানে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, আজও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেছে। মিয়ানমারের কাছাকাছি হওয়ায় তার এলাকার মানুষের জীবনযাপনে আঘাত হেনেছে। তার এলাকায় নারী ও শিশুরা আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারছে না। ইতোমধ্যে অনেকেই কক্সবাজারে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় ও ভাড়া বাসায় যেতে বাধ্য হয়েছে।
সীমান্তে নিরাপত্তা ও টহল জোরদার
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম ছাড়াও তুমব্রু এলাকায়ও এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। থেমে থেমে, আবার কখনো এক টানা সীমান্তের ওপারে কয়েক দিন ধরে শোনা যাচ্ছে গোলাগুলির শব্দ।
এদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে টহল জোরদার করেছে বলে জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বুধবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুরে ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন।
প্রথমে জেলা প্রশাসক তমব্রু এলাকায় নির্মাণাধীন শরণার্থী ট্রানজিট ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। পরে তিনি ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন এবং শেষে সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে মতবিনিময় করেন।
এ সময় তিনি সার্বিক পরিস্থিতি প্রশাসনের নজরে রয়েছে নিশ্চিত করে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান।
জেলা প্রশাসক বলেন, সার্বিক বিষয় প্রশাসন মনিটরিং করছে। মিয়ানমারের এই সময়ের ঘটনায় এপারে আতঙ্ক থাকলেও সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
এ সময় পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন, সহকারী পুলিশ সুপার মো: আমজাদ হোসেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: জাকারিয়াসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সতর্ক অবস্থানে কোস্টগার্ড
মিয়ানমারে চলমান সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতিতে টেকনাফ সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে টহল এবং নজরদারি জোরদার করেছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড।
কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, পার্শ্ববর্তী দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় বাংলাদেশের উপকূলবর্তী সীমানায় যেন বিরূপ প্রভাব না পড়ে তার জন্য সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড।
সমুদ্রে সার্বক্ষণিক টহল জাহাজ মোতায়েনসহ টেকনাফ থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত দিন-রাত নিয়মিত অত্যাধুনিক হাইস্পিড বোটের মাধ্যমে টহল পরিচালনা করছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড।
এছাড়াও টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, বাহারছড়া ও সেন্টমার্টিনে বর্তমানে অতিরিক্ত জনবল মোতায়েন করার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং দেশের মানুষের জান-মালের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সদা প্রস্তুত রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
সীমান্তের ভেতরে আসা তিনটি মর্টারশেল
বুধবার (৩১ জানুয়ারি) ভোরে মিয়ানমারে ছোঁড়া তিনটি মর্টারশেল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের তুমব্রুতে এসে পড়ে। তবে এতে কোনো হতাহত হয়নি।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তুমব্রু সীমান্তে কোনাপাড়া ও পশ্চিমকুল পাড়া এলাকায় মিয়ানমারের ছোঁড়া তিনটি মর্টারশেল এসে পড়েছে। আমার এলাকায় পশ্চিমকূলে বসবাসকারী নুরুল ইসলাম ও সাবেক মেম্বার গফুর চৌধুরীর বাড়ির উঠানে এসে মর্টারশেল পড়েছে। তবে কেউ হতাহতে হয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘মর্টারশেলগুলো বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাতে ব্যাপক মর্টারশেল ও গোলাগুলি হলেও বুধবার সকাল থেকে কিছুটা কমেছে। এই সীমান্তের বেশিভাগ লোকজনের সংসার চলে চাষাবাদ করে। কিন্তু সীমান্তে গোলাগুলির কারণে এসব লোকজন জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে।’
রাখাইনে মুসলিম পাড়ায় আক্রমণ হচ্ছে
মিয়ানমার রাখাইনে বসবাসরত অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতে নতুন করে পায়তারা শুরু করেছে বলে মনে করছে অনেকে। রাখাইনে নতুন করে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে জান্তা বাহিনীর লড়াইকে নাটক বলছে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা।
সোলতান আহমদ, ছানা উল্লাহ, নুর করিমসহ একাধিক রোহিঙ্গা বলেন, ‘তারা তো লড়াই করছে না, তারা পরিকল্পনা করে মুসলিম পাড়ায় আক্রমণ করছে। তারা তো মগ পাড়ায় যায় না লড়াই করতে।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো: এরফানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আজও গোলাগুলির শব্দ নাফ নদীর সীমান্তে বসবাসকারী লোকজন শুনেছে। আমরা এখানকার মানুষদের সর্তক থাকতে বলেছি।’
নতুন করে যেন কোনো অনুপ্রবেশ ঘটতে না পারে তার জন্য আমাদের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী সর্তক অবস্থানে রয়েছে বলেও জানান তিনি।