বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে মশাবাহিত রোগ ‘জাপানিজ এনকেফালাইটিস’। এই ভাইরাসটি মূলত কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ছড়ায়।
এই পর্যন্ত ৬৪টি জেলার ৩৬টিতে এই রোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গিয়েছে।
বাংলাদেশে এই রোগ এখনো খুব আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে না গেলেও মানবদেহে রোগটির প্রভাব মারাত্মক হওয়ায় এখন থেকেই সচেতনতার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
আইসিডিআর,বি-এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আক্রান্ত রোগীদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজন রোগী মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে- রোগটির মৃত্যু হার ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ আক্রান্ত ১০০ জনের ৩০ জনই মারা যান।
আবার আক্রান্ত যারা বেঁচে থাকেন তাদের মধ্যে ৩০-৫০ শতাংশ রোগীর শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা তৈরি হয়।
যেমন: স্থায়ী বুদ্ধিবৃত্তিক, আচরণগত ও স্নায়বিক ক্ষতি হয়, অনেকে পঙ্গু হয়ে পড়েন, বার বার খিঁচুনি হয়, রোগী আর কথা বলতে পারেন না।
সকল বয়সের মানুষের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও ১৫ বছর বা এর চেয়ে কম বয়সের শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি।
প্রতি চারজন রোগীর মধ্যে তিনজনের বয়স ১৫ বছর বা এর চেয়ে কম।
এছাড়া শিশুদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক মো: সাখাওয়াত উল্লাহ জানান, তাদের কাছে যেসব রোগী আসছেন তাদের মধ্যে অনেকেই শিশু। তাদেরকে প্রায়ই অজ্ঞান অবস্থায় ভর্তি করা হয়।
যেহেতু শিশুরা বাইরে খেলাধুলা করে, ফলে তারা সহজেই মশার সংস্পর্শে বেশি আসে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
জাপানিজ এনকেফালাইটিস বাংলাদেশে সর্বপ্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে, ময়মনসিংহ জেলার একটি গ্রামে।
সে সময়ে ২২ জন এতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এরমধ্যে সাতজন মারা যান।
তবে এ নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩ সাল থেকে। সে সময় রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, চট্টগ্রাম- এই ৪টি জেলার টারশিয়ারি হাসপাতালে নজরদারি করা হলেও সারা দেশের ৬৪ জেলায় সার্ভেলেন্স শুরু হয় ২০১৭ সাল থেকে, যা এখনো চলছে।
বর্তমানে দেশব্যাপী ৮২টি সরকারি হাসপাতাল এবং ২১টি বেসরকারি হাসপাতালে জাপানিজ এনকেফালাইটিস রোগী শনাক্তকরণের লক্ষ্যে সার্ভেলেন্স চলমান রয়েছে।
সারা বছরই এ রোগে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় তবে মে মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা সব চাইতে বেশি দেখা যায়।
উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে এ রোগের প্রকোপ বেশি।
গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে রংপুর বিভাগে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাং রোগী শনাক্ত হয়েছে, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রাজশাহী বিভাগের শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ এবং তৃতীয় স্থানে থাকা চট্টগ্রাম বিভাগে শনাক্তের হার ৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ সারা বছর ঘটতে পারে তবে উষ্ণ মৌসুমে ও বর্ষাকালে এর সংক্রমণ তীব্র হয়।
গ্রামাঞ্চলে রোগটির প্রাদুর্ভাব বেশি। বিশেষ করে যেখানে কৃষিকাজে সেচ ব্যবহার হয় সেসব জায়গায়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদ বলেন, “যেসব অঞ্চলে ধান চাষ করতে সেচ ব্যবহার হয় সেখানে কিউলেক্স মশা বংশবৃদ্ধির উপযুক্ত পরিবেশ পায়। বর্ষায় এদের সংখ্যা বাড়ে আবার শীতকালে সেচের ব্যবহারেও মশা বাড়তে থাকে।”
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর, আইসিডিডিআর,বি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এই রোগের প্রভাব, বিস্তার ও প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন গবেষণা এবং সার্ভেলেন্স কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
পরবর্তীতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন মা, নবজাত শিশু এবং কিশোর কিশোরীর স্বাস্থ্য (এমএনসিএন্ডএএইচ), রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর) ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আইসিডিডিআর,বি এবং পাথ (পিএটিএইচ) এই কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়।
নিঃস্ব হচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো
জাপানিজ এনকেফালাইটিসের কারণে বাংলাদেশ গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
বিশেষকরে- যে সমস্ত পরিবারের সদস্যরা এই রোগে আক্রান্ত হয় তারা সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন বলে আইসিডিডিআর,বি’র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সেখানে বলা হচ্ছে, এই রোগের তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য একটি পরিবারকে গড়ে ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা খরচ করতে হয় এবং দীর্ঘকালীন চিকিৎসার জন্য ৪০০০ থেকে ৬০০০ টাকা প্রতি মাসে খরচ করতে হচ্ছে।
এছাড়াও যে সকল রোগীর শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা তৈরি হয় এবং কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন সে সব রোগীর পরিবারকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।
আইসিডিডিআরবির প্রধান গবেষক রেবেকা সুলতানা বলেন, “আমরা এমন কিছু পরিবারকে দেখেছি যারা ধার করে চিকিৎসা করতে করতে আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। বাধ্য হয় তাদের শেষ সম্বল জমিটুকুও বিক্রি করে দিচ্ছেন। উত্তরাঞ্চলের এই মানুষগুলো এমনিতেই দরিদ্র্য। তার ওপর এই রোগের কারণে তারা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।”
এনকেফালাইটিস কী ও এর লক্ষণ
জাপানিজ এনকেফালাইটিস হলো মশার মাধ্যমে ছাড়ানো ভাইরাসজনিত রোগ। এটি মূলত কিউলেক্স মশার কামড়ে মানুষের মধ্যে ছড়ায়।
এই রোগ সর্বপ্রথম জাপানে শনাক্ত হয়েছিল ১৮৭১ সালে। পরবর্তীকালে রোগটি এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে, যা প্রায় তিন শ’ কোটি মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলে এবং দক্ষিণে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
এই রোগের লক্ষণসমূহ ১-৬ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। রোগটির প্রধান লক্ষণগুলো হচ্ছে-
জ্বর ও দুর্বলতা।
গায়ে ব্যথা।
মাথায় যন্ত্রণা।
ঘাড়ের জড়তা বা শক্ত হয়ে যাওয়া।
খিঁচুনি।
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
মানসিক বিভ্রম (ভুল বকা)।
দেহের কোনও অংশের অসারতা।
কখনও কখনও রোগী কোমা অবস্থাতেও চলে যেতে পারেন।
শিশুদের মধ্যে পেট ব্যথা এবং বমি হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
সাধারণত মশা কামড় দেয়ার চার থেকে ১৪ দিনের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
আবার অনেকে ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও কোন উপসর্গ দেখা যায় না।
তবে এই ভাইরাসটি একজন রোগীর থেকে অন্য সুস্থ লোকের শরীরে ছড়ায় না। শুধুমাত্র ভাইরাসবাহী মশা কামড়ালেই ছড়াবে।
গবাদি পশুরাও মশার মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এসব প্রাণীর ক্ষেত্রে রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান লক্ষণ হলো- গাভীর সন্তানহীনতা, গর্ভপাত, জ্বর ও আলস্যভাব।
পশুর মধ্যে এমন লক্ষণ দেখলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
চিকিৎসা
কোনো রোগীর মধ্যে ওপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে, তাকে সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের সব সরকারি জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে এ রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে বলে জানা যায়।
অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি শনাক্ত করা হয়।
তবে এই রোগের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা অ্যান্টিভাইরাল নেই। এ কারণে হাসপাতালগুলোয় রোগীকে মূলত সাপোর্টিভ চিকিৎসা দেয়া হয়। অর্থাৎ যেমন উপসর্গ তেমন চিকিৎসা।
ভাইরাস সংক্রমণের ফলে রোগীর মস্তিষ্কে প্রদাহ তৈরি হতে পারে। তাই সময়মত চিকিৎসা না নিলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন।
দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা গেলে রোগী সুস্থ হতে পারেন।
মশা নিয়ন্ত্রণেই রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?
জাপানিজ এনকেফালাইটিস থেকে বাঁচার স্থায়ী সমাধান হিসেবে টিকা দেয়ার ওপরেই জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের প্রকৃতিতে যতো প্রজাতির মশা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মশা হলো কিউলেক্স।
তবে এই মশা কামড়ালেই যে কেউ জাপানিজ এনকেফালাইটিসে আক্রান্ত হবেন এমনটা নয়। শুধুমাত্র ভাইরাসবাহী কিউলেক্স মশা বিপদজনক।
এ মশা সাধারণত জমে থাকা পানিতে বংশবিস্তার করে। তাই বাড়ির আঙ্গিনায় পানি জমলে সেগুলো পরিষ্কার করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মশার কামড় এড়াতে ব্যক্তিগত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে মশা তাড়ানোর ওষুধ ছেটানো, মশারি ব্যবহার, লম্বা হাতের কাপড় পরিধান।
এককথায় প্রাথমিকভাবে রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত কিউলেক্স মশা নিধন জরুরি।
এক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতার পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভাকে মশা নিধনে ও মশার বংশবৃদ্ধি নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেয়া হচ্ছে।
সেইসাথে আক্রান্ত এলাকায় ভ্রমণের আগে ভ্রমণকারীদের টিকা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
তবে মশা নিয়ন্ত্রণের চাইতে মানুষের টিকাদানকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষকরে ভাইরাস সংক্রমণের জন্য যেখানে উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে সেখানে টিকা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার কথা বলা হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদ জানান, “শুধু মশা নিয়ন্ত্রণ করে কোনো রোগ শতভাগ নির্মূল সম্ভব নয়। এজন্য একমাত্র উপায় হলো টিকা। বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরেই এই টিকা আনার কথা বলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি দেখছি না। সরকারের উচিত দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া।”
টিকা কতদূর
সাধারণত কেউ একবার টিকা নিলে আজীবন এই রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালে জাপানিজ এনকেফালাইটিস রোগের টিকার অনুমতি দিয়েছে।
ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, মালয়েশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ তাদের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে জাপানিজ এনকেফালাইটিসের টিকা প্রবর্তন করে রোগটির প্রকোপ অনেকটাই কমিয়ে এনেছে।
বাংলাদেশ এখনো জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে এই ভ্যাকসিন চালু করেনি। তবে সরকার জাপানিজ এনকেফালাইটিসের টিকা দেয়ার লক্ষ্যে বেশ কিছু পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণের কথা বলেছে।
এই টিকার সফল বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ থেকে থেকে জাপানিজ এনকেফালাইটিস রোগটি নির্মূল করা সম্ভব হবে বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সাধারণত নতুন কোনো টিকা আনতে গেলে টিকা বিষয়ক জোট- গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনের (গাভি) কাছে আবেদন জানাতে হয়। এরপর সেরাম ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে এই টিকাগুলো দেশে আসে।
টিকার জন্য গাভিতে আবেদন এখনো প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছেন আইসিডিডিআর,বির প্রধান গবেষক রেবেকা সুলতানা।
টিকা পাওয়া গেলে এটি রাজশাহীর ২টি জেলা ও রংপুরের ২টি জেলায় দেয়ার কথা রয়েছে। তবে এই তালিকায় চট্টগ্রামকেও যুক্ত করার কথা জানিয়েছেন তিনি।
সরকার এই টিকাটি হাতে পেলে একে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এছাড়া যেসব অঞ্চলে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি সেখানে ১৫ বছর বা তার কম বয়সীদের এই টিকা দেয়ার ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগে প্রচার প্রচারণা চালানোর কথা রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে চার ধরনের ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এরমধ্যে চীনে উৎপাদিত লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড SA14-14-2 সর্বাধিক ব্যবহৃত টিকা।
সূত্র : বিবিসি