দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা ও দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, তখন দরিদ্র ও অতিদরিদ্র পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। এবার রাজধানীর মুরগির বাজার যেন লাগামছাড়া! একদিনের ব্যবধানে রেকর্ড গড়ে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে কেজি ঠেকেছে ২৪০ টাকায়। এর উত্তাপ আবার ছড়িয়েছে ডিমের বাজারেও। এ ছাড়া বাজারে অন্যান্য মাংসের দামও বাড়তি। গরুর মাংস কেজিপ্রতি ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা ও খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়। ঊর্ধ্বগতির দিকে রয়েছে চাল, ডাল, আটা, ময়দা ও সয়াবিন তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য। রমজান এলেই চিনি, খেজুর, ছোলা, তেলের মতো কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
রমজান কবে হবে, এটি তো এক বছর আগেই সবার জানা। কিন্তু সহজে বাজার নিয়ন্ত্রণের কাজটিও সময়মতো করা হয়ে ওঠে না। তাই রমজান এলেই বাজারের পাগলা ঘোড়া আরও জোরসে ছোটে। সরকার যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নেয়, রমজানের বাড়তি চাহিদা বিবেচনা করে আমদানি বাড়িয়ে সরবরাহ ঠিক রাখে, তা হলে হয়তো পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এদিকে আসন্ন রমজান মাস মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। রমজান মাসে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা সংযমের মাধ্যমে আল্লাহ নৈকট্যলাভের আশায় সিয়াম সাধন করে থাকেন। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশে যেখানে রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য সীমিত করে রাখে, সেখানে বাংলাদেশে ঠিক এর উল্টো। রোজা আসার আগেই ক্রমাগত বাড়তে থাকে দ্রব্যমূল্য। আমাদের দেশের সিংহভাগই মুসলিম। তাই এ মাসে প্রায় সব পরিবারেই বাড়তি একটি চাহিদা থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই চাহিদা কেন্দ্র করে একশ্রেণির মুনাফালোভী বাজার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে থাকে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজ করছে, দেখা দিয়েছে চরম মুদ্রাস্ফীতি। ক্রয়ক্ষমতা এমনিতেই সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে। এর ওপর রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের বাড়তি দাম এক ধরনের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতোই।
জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বুভুক্ষু মানুষকে অর্ধাহার ও অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য করছে। শুধু যে পণ্যদ্রব্যের দামই বেড়েছে, তা নয়; বেড়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম, পরিবহন ব্যয় ও বাসাভাড়া। করোনার ধাক্কা সামলে বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশেই কমবেশি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হয়। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর পরই আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারকে আরও উসকে দেয়। বাংলাদেশকেও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাড়তি দামে পণ্য ও কাঁচামাল কিনতে হচ্ছে। এতে আমদানি খরচ বেড়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি খরচ আরও বেড়েছে। এ ছাড়া দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করায় উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। ফলে নিত্যপণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছেই।
গ্রাম থেকে জীবিকার খোঁজে আসা অনেকের স্বপ্ন থাকে রাজধানী ঢাকায় থাকবেন। সন্তানদের ভালো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে ভবিষ্যৎ গড়বেন। কিন্তু জীবনযাত্রার অত্যধিক ব্যয়ে সেসব মানুষ বা পরিবারগুলোর ঢাকায় থাকার স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে। কর্মহীন হয়ে পড়া, চাকরিতে বেতন না পাওয়া এবং বৃদ্ধিসহ নানা সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে টিকতে না পেরে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেরই এখন এ শহরের মায়া ছাড়তে হচ্ছে। গত এক বছরে সংসারের ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। স্ত্রী-সন্তানের মুখে তিনবেলা ভাত তুলে দিতেই কষ্ট হয় অনেকের। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে গ্রাম থেকে আসা সব মানুষকে ওই গ্রামেই ফিরে যেতে হচ্ছে। মানুষ এখন অর্থনৈতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় চাপে রয়েছেন ভোক্তারা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। আমাদের সাধারণ মানুষের আয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের বেশিরভাগ মানুষ বহু চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়। ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখতে অবিলম্বে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রতিহত করতে হবে। গরিবরা ডাল-ভাতটুকুও খেতে পারছেন না। মধ্যবিত্তরাও বাজার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সরকার খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে চালসহ প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করলেও তা অত্যন্ত সীমিত। এটি সারাবছর চালু রেখে পরিধি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সরকার নয়, বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন ব্যবসায়ীরাই। সিন্ডিকেটকারীদের দৌরাত্ম্য কমেনি। কৃত্রিম সংকট, সরবরাহ ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক বাজারদর বৃদ্ধি এসব অজুহাতে সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন এবং ক্রমেই এসব পণ্য সংগ্রহ করা কঠিনতর হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য। পণ্যের মূল্য নির্ধারণ, আমদানি ও ভর্তুকিমূল্যে পণ্য বিক্রি করেও সিন্ডিকেট ঠেকানো যাচ্ছে না। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা রয়েছেন যারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। তারা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন, নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দেন। তাদের ঠেকাতে হবে। এর পাশাপাশি বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। আমদানি-সুবিধা দিয়ে হলেও সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধি করার সুযোগ পাবেন না। নিত্যপণ্যের দাম কমাতে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সৈয়দ ফারুক হোসেন : রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়