সরকারি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় নাম আসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. নিখিল রঞ্জন ধরের। পুলিশের কাছে এবং আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এ শিক্ষকের নাম বলেছিলেন মূলহোতা দেলোয়ারসহ অন্য আসামিরা। কিন্তু নিখিল রঞ্জন ধরের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। অর্থপাচারের অভিযোগে সিআইডির করা মামলাতেও নাম নেই তার।
অভিযোগপত্র থেকে নিখিল রঞ্জন ধরের নাম বাদ দেওয়ায় ঢাকা মহানগর আদালতের হাকিম এক লিখিত নির্দেশে বলেছেন, ১৬১ ও ১৬৪ ধারায় আসামিদের জবানবন্দিতে নাম আসা আসামিকে চার্জশিটে যুক্ত না করলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বাড্ডা থানায় করা মামলার তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক শামীম আহমেদ। তিনি মামলার অভিযোগ থেকে শিক্ষক নিখিল রঞ্জনকে বাদ দেওয়ার কথা জানান।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, নিখিল রঞ্জন ধর আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে মুদ্রিত প্রশ্নপত্রের কোনো কপি পাননি। দেলোয়ার হোসেন তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ কথা জানান। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অধ্যাপক নিখিলের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ বা অভিযোগ পাননি বলে দাবি করেছেন গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা।
তবে ঢাকা মহানগর আদালতের বিজ্ঞ হাকিম গত ১৭ জানুয়ারি এক লিখিত আদেশে বলেন, আসামি দেলোয়ার হোসেন তার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি নিখিল রঞ্জন ধর নামে একজন ব্যক্তির মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত উল্লেখ করেন। এ ছাড়া সাক্ষীরা তাদের ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে তার নাম বলেছেন। কিন্তু অভিযোগপত্রে আসামির নাম যুক্ত করা হয়নি। আসামিকে চার্জশিটে যুক্ত না করলে সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
জানা গেছে, বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (এইউএসটি) কাজ করতেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার টেন্ডার এনে দেওয়াসহ এইউএসটির বিভিন্ন কাজ করে দিতেন তিনি। তিনি পরীক্ষা কমিটির কেউ না হলেও তার তত্ত্বাবধানেই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা নেওয়া হতো। নিখিল রঞ্জন নিয়োগ পরীক্ষার কমিটিতে না থাকলেও প্রশ্নপত্র ছাপানোর দিন সকাল থেকে ভোর পর্যন্ত আহছানিয়া মিশনের ঢাকার আশুলিয়ার ছাপাখানায় অবস্থান করতেন। ফেরার সময় দুই কপি প্রশ্ন সঙ্গে আনতেন। প্রশ্ন ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতেন এইউএসটির পিয়ন দেলোয়ার।
নিখিল রঞ্জন ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৬৬টি ব্যাংক হিসাবের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের বুয়েট শাখায় রয়েছে ১৪টি। তার মধ্যে একটি হিসাব বন্ধ। বুয়েট শাখা ছাড়া অন্য ব্যাংকসমূহে অর্থের উৎস হিসেবে বুয়েটে অধ্যাপনা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তাতে বুয়েট থেকে কোনো অর্থ জমা হয়নি। অধিকাংশ হিসাবেই নগদে অর্থ জমা হয়েছে। অর্থ জমা হয়েছে আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব থেকেও। এর মধ্যে নিখিল রঞ্জনের নামে ঢাকা ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জমা হয়। এই অর্থের বেশির ভাগই জমা পড়েছে নিখিল রঞ্জন ধর ও অনুরূপা ধরের অন্যান্য হিসাব থেকে।
জানা গেছে, প্রাইম ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখার অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এই হিসাবটিতে আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (এইউএসটি) সেন্টার ফর এক্সটেনশন সার্ভিসের হিসাব থেকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। নিখিল রঞ্জন ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটি, প্রশ্ন মডারেশন কমিটি, প্রশ্ন কম্পোজিটর, প্রশ্ন প্রেসে বহনকারী ও সংরক্ষণকারী কোনো কিছুতেই যুক্ত না থাকলেও বিপুল অংকের টাকা দেওয়া রহস্যজনক বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
কারওয়ানবাজার শাখায় ২০১৯ সালে খোলা তার সঞ্চয়ী হিসাবে জমা হয় ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। হিসাবটিতে লেনদেনের উৎস দেখানো হয়েছে বুয়েট থেকে পাওয়া বেতন-ভাতা। তবে বুয়েট থেকে কোনো অর্থ জমা হয়নি। তবে ২০১৯ সালে এই হিসাবে ৪০ লাখ টাকা জমা হয় আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (এইউএসটি) সেন্টার ফর এক্সটেনশন সার্ভিসেসের হিসাব থেকে, যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অভিযুক্ত।
এদিকে নিখিল রঞ্জন ধর সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা রুমা দাস কেয়াকে ২০২১ সালে তিনটি লেনদেনের মাধ্যমে ২২ লাখ টাকা দেন। রুমা দাস ২০১১ সালে সোনালী ব্যাংকের উত্তরখান শাখায় সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ব্যাংক কর্মকর্তাকে বিপুল অংকের টাকা দেওয়াকে রহস্যজক বলছেন গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্ত প্রতিবেদনও বলছে, ওই অধ্যাপকের হিসাবে ২০১৯ সালে এইউএসটির সেন্টার ফর এক্সটেনশন সার্ভিসের হিসাব থেকে ৭০ লাখ টাকা জমা হয়। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তার সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৭১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, যা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, নিখিল রঞ্জন ধর ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসাবসমূহে সম্পাদিত লেনদেনসমূহের মধ্যে দৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্বাচিত লেনদেনগুলো পর্যবেক্ষণে প্রায় ৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকার লেনদেন ‘সন্দিগ্ধ’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
আহছানিয়া মিশন প্রেসের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, ২০২১ সালের ২ নভেম্বর তাদের ছাপাখানায় সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ছাপা হয়। সেদিন সকাল থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত নিখিল রঞ্জন ওই ছাপাখানায় ছিলেন। আসার সময় প্রশ্নের দুটি কপি তিনি নিয়ে যান।
এইউএসটির পিয়ন দেলোয়ার হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়োগ পরীক্ষার টেন্ডারগুলো আনতেন বুয়েটের শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। তিনিই সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রতিবার প্রশ্নপত্র ছাপার পর দুই সেট প্রশ্ন তিনি নিখিল রঞ্জনের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতেন। কোনো প্রশ্ন করলে চাকরিচ্যুত করার হুমকিও দিতেন তিনি। এদিকে পাঁচ ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গত ৭ জুন জনতা ও রূপালী ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের নামে অর্থপাচারের মামলা হয়।
সিআইডি বলেছে, অন্তত ৩শ পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নপত্র বিক্রির তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। তবে নিখিল রঞ্জনের বিরুদ্ধে মামলা না করার ব্যাপারে সিআইডি কর্মকর্তাদের দাবি, নিখিল রঞ্জনের সন্দেহজনক লেনদেনের কিছু প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কাকে কীভাবে দিয়ে তিনি টাকা নিয়েছেন, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাই মামলার আসামি করা হয়নি। তবে প্রমাণ পেলে চার্জশিটে তার নাম যুক্ত করা হবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ব্যাংকের লেনদেনের বিষয়ে গতকাল শনিবার নিখিল রঞ্জন ধরকে টেলিফোন করলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় শুনেই ফোন কেটে দেন। এর পর তিনি আর ফোন ধরেননি। তার ব্যক্তিগত নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। সেই বার্তা তিনি দেখলেও কোনো উত্তর দেননি। তবে গত বছর তিনি আমাদের সময়কে বলেছিলেন, ‘মূলত এইউএসটি কর্তৃপক্ষের ডাকে ছাপাখানায় যেতাম। ছাপার পর প্রশ্নপত্রে ভুল আছে কিনা, আমি সেটা দেখতাম। প্রশ্নপত্র কোথায় রাখব ভেবে ব্যাগেই রাখতাম। ফেরার সময় সেটা বর্জ্য হিসেবে সিলগালা করে দিতাম।’ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বড় অংকের লেনদেনের ব্যাপারে তার ভাষ্য ছিল, ‘দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করি। সেই বেতনের টাকা ব্যাংকে লেনদেন হয়েছে। সেটা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনেছি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় ২০২১ সালের ৬ নভেম্বর ঢাকায় বিভিন্ন কেন্দ্রে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। ১ হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে পরীক্ষা দেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন। এই পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।