আল্লাহ তাআলা বান্দার ওপর প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। আবার এ নামাজ পড়ার সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করারও নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে কোরআন সুন্নায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।
তাই কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মোতাবেক ফজর, জোহর, আসর,মাগরিব ও এশার নামাজ নির্ধারিত সময়েই আদায় করতে হবে। কিন্তু ফরজ এ নামাজগুলো পড়ার সময় সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা কী? এর সময়সীমা কতক্ষণ? এ সম্পর্কে হাদিসের দিকনির্দেশনাই বা কী?
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আল্লাহ তাআলা যখনই কোনো ফরজ (নামাজ) তার বান্দাদের উপর অবধারিত করেন; তখনই তার একটা সীমা (সময়ও) নির্ধারণ করে দেন। তারপর (একান্তই) যারা সেটা করতে সক্ষম হবে না তাদেরকে ভিন্ন পথ বাতলে দিয়েছেন। এর ব্যতিক্রম হচ্ছে- আল্লাহর জিকির। এই জিকির এর ব্যাপারে যতক্ষণ কেউ সুস্থ বিবেকসম্পন্ন থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তাআলা কাউকে ওজর আপত্তি পেশ করার সুযোগ দেননি। সর্বাবস্থায় তাকে জিকির করতে হবে। রাত-দিন ও জল-স্থলে চালিয়ে যেতে হবে। কোরআনুল কারিমের ঘোষণাও এটি। আল্লাহ তাআলা বলেন-
فَأَقِيمُواْ الصَّلاَةَ إِنَّ الصَّلاَةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَّوْقُوتًا
‘এরপর নামাজ ঠিক করে পড়। নিশ্চয়ই নামাজ মুসলমানদের উপর ফরজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১০৩)
ফরজ নামাজগুলো কখন পড়বেন?
নামাজেরর প্রথম ও শেষ সময় আছে। এ নামাজ পড়ার সর্বোত্তম সময় হচ্ছে প্রথম সময়ে পড়া। অর্থাৎ ওয়াক্ত হওযার সঙ্গে সঙ্গে জামাতে নামাজ আদায় করা। হাদিসে পাকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সম্পর্কে বলেন-
‘নামাজেরর প্রথম ও শেষ সময় আছে। জোহরের নামাজের প্রথম সময় হচ্ছে যখন সূর্য হেলে যাবে। আর শেষ সময় হচ্ছে, আসরের ওয়াক্ত প্রবেশ করা পর্যন্ত। অনুরূপভাবে আসরের প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন এর ওয়াক্ত হবে। আর তার শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত। তদ্রুপ মাগরিবের প্রথম সময় হচ্ছে যখন সূর্য ডুবে যায়। তার শেষ সময় হচ্ছে, যখন দিগন্ত রেখা চলে যায়। আর এশার প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন দিগন্ত রেখা চলে যায়। আর শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে, মধ্য রাত পর্যন্ত। ফজরের প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন সুবহে সাদিক উদিত হয়। আর শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন সূর্য উদিত হয়।’ (তিরমিজি)
১. ফজরের নামাজ পড়ার সময়
সুবহে সাদেক থেকে ফজরের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়। রোজাদারের জন্য পানাহার নিষিদ্ধের সময়ও এটি। আর সুবহে সাদেক বলা হয় সেই সময়কে, যে সময়ে ভোরের আভা পুব আকাশে উত্তর-দক্ষিণে বিস্থির্ণ অবস্থায় দেখা যায়। আর এর শেষ সময় হল সূর্যোদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় ফজরের নামাজের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এই নামাজ প্রথম ওয়াক্তে ‘গালাসে’ (একটু অন্ধকার অন্ধকার ভাব সময়ে) পড়া উত্তম। হাদিসে এসেছে-
বিজ্ঞাপন
> হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাজ পড়তেন। এরপর নারীরা তাদের চাদর জড়িয়েই নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেতেন। কিন্তু অন্ধকারের জন্য তাদেরকে চেনা যেতো না।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
> হজরত আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাজ পড়লেন, যখন কেউ তার পাশ্ববর্তী সঙ্গীর চেহারা চিনতে পারতো না অথবা তার পাশে কে রয়েছে তা জানতে পারতো না।’ (আবু দাউদ)
> হজরত আবু মাসউদ আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি (রাসুলুল্লাহ) একবার ফজরের নামাজ অন্ধকারে (খুব ভোরে) পড়লেন। এরপর দ্বিতীয় বার ফর্সা করে পড়লেন। এরপর তাঁর ফজরের নামাজ অন্ধকারেই হতো। আর তাঁর ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত কোনো দিন পুনরায় (ফজরের নামাজ) ফর্সা করে পড়েননি।’ (আবু দাউদ)
বিজ্ঞাপন
> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা ফজরের নামাজ ফর্সা করে পড়। কারণ, তাতে সাওয়াব অধিক।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ, মিশকাত)
এতো ভোরে ফজর পড়া যাবে না; যে সময় ফজরের ওয়াক্ত হয়নি। ফজরের সময় নিশ্চিত হতে হবে। নিশ্চিতরূপে ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার বিষয়টি না জেনে তাড়াহুড়ো করা যাবে না।
তবে ফজরের নামাজ লম্বা কেরাতে ফর্সা করে পড়া। এতে বেশি সওয়াবের কথা এসেছে। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এই নামাজে (কখনো কখনো) ৬০ থেকে ১০০ আয়াত পর্যন্ত পড়তেন এবং যখন নামাজ শেষ করতেন, তখন প্রত্যেকে তার পাশের সাথীকে চিনতে পারত। (বুখারি)
হাদিস বিশারদদের বর্ণনায় বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, যেহেতু তাঁর আমল মৃত্যু পর্যন্ত ফজরের নামাজ ফর্সা করে ছিল না, বরং এ নামাজ তিনি একটু অন্ধকার থাকতেই শুরু করতেন, তাই অন্ধকার ও ফর্সায় ফজর পড়ায় কোনো বৈষম্য নেই। বরং ফজর সুবহে সাদেকে অন্ধকার থাকতেই শুরু করা যুক্তিযুক্ত। আর নামাজ শেষ করতে করতে অনেক সময় আকাশ ফর্সা হয়ে যেতো।
সুবহে সাদিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফজর নামাজের সময় শুরু হয়। আর তা পড়তে হয় সূর্য ওঠার আগে। সুবহে সাদিক হলো- শেষ রাতে পূর্ব আকাশে লম্বা আকৃতির যে আলোর রেখার আভাস দেখা যায়। তা দেখা যাওয়ার পর থেকে সূর্য ওঠার বেশ কয়েক মিনিট (২০-২২) আগে ফজরের নামাজ পড়া শেষ করতে হয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় ‘গালাস’ বা খুব ভোরের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে ফাজরের নামাজ আদায় করতেন। তবে তিনি জীবনে একবার মাত্র ‘ইসফার’ বা চারদিক ফর্সা হওয়ার সময়ে ফাজরের নামাজ আদায় করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফাজরের নামাজ আলো-আধারিতে আদায় করাই ছিল তাঁর নিয়মিত অভ্যাস। এ কারণেই ফাজরের নামাজ ‘গালাস’ তথা খুব ভোরের আলো-আধারিতে আদায় করাই উত্তম।
তাইতো ইমাম তাহাভি, আবু হানিফা, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে, হাদিসের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ফাজরের নামাজ অন্ধকারে তথা আলো-আধারিতে শুরু করা এবং একটু ফর্সা হলেই শেষ করা উচিত।’ (শারহু মাআনিল আসার)
২. জোহরের নামাজ পড়ার সময়
দুপুরের সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিম আকাশে একটু হেলে পড়লেই জোহরের নামাজের সময় শুরু হয়। তবে জোহরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার ব্যাপারে একাধিক মত পাওয়া যায়। তাহলো-
> সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লে কোনো বস্তুর নিজস্ব ছায়ার একগুণ হলেই ওয়াক্ত শেষ হয়।
> আবার ছায়ায়ে আসলি বা দ্বিপ্রহরের ছায়া ছাড়া প্রত্যেক জিনেসের ছায়া তার দ্বিগুণ হওয়া পর্যন্ত জোহরের নামাজ পড়া যায়। তবে গরমের সময় জোহরের নামাজ দেরিতে এবং শীতের সময় প্রথম ওয়াক্তে আদায় করা মোস্তাহাব।
ছায়ায়ে আসলি কী?
ঠিক দ্বিপ্রহরের সময় সমতল ভূমিতে কোনো বস্তুর যে ছায়া থাকে, তাকেই ‘ছায়ায়ে আসলি’ বলা হয়।
জুমা : শুক্রবার জোহরের ওয়াক্তে জুমার নামাজ আদায় করতে হয়। জুমার নামাজের জন্য আলাদা কোনো সময় নেই বরং জোহরের নির্ধারিত সময়েই জামাতের সঙ্গে জুমা আদায় করতে হয়। জুমার নামাজ জামাত ছাড়া আদায় করা যায় না।
৩. আসরের নামাজ পড়ার সময়
জোহরের সময় শেষ হলেই আসরের সময় শুরু হয়। কোনো বস্তুর ছায়া সমপরিমাণ/দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আসরের নামাজের সময় শুরু হয়। আর তা সূর্য ডোবার বা অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত আসরের নামাজের সময় থাকে।
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সূর্য যখন হলুদ রং হয় এবং শয়তানের দু’শিংয়ের মাঝখানে এসে যায়; তখন মুনাফিকরা নামাজ পড়ে।’ সুতরাং সূর্যের আভা একটু হলদে রং হয়ে আসার আগেই আসর নামাজ আদায় করা উচিত।
৪. মাগরিবের নামাজ পড়ার সময়
সূর্য ডোবার পরই মাগরিবের নামাজের সময় শুরু হয় এবং পশ্চিম আকাশে সূর্যের লালিমা শেষ হওয়া পর্যন্ত মাগরিবের নামাজ পড়া যায়। তাই সূর্যাস্তের পর দেরি না করে মাগরিবের নামাজ আদায় করা মোস্তাহাব।
৫. এশার নামাজ পড়ার সময়
মাগরিবের সময় শেষ হলেই এশার সময় শুরু হয়। পশ্চিম আকাশের লাল আভা দূর হওয়ার পর আকাশ প্রান্তে যে সাদা আভা চোখে পড়ে তা বিলুপ্ত হওয়ার পরই মূলত এশার নামাজের সময় শুরু হয়। এশার সময় শুরু হওয়ার সঙ্গে সবাই একমত হলেও শেষ হওয়া সম্পর্কেও একাধিক মত পাওয়া যায়। তাহলো-
> এশার সময় শুরু হওয়ার পর থেকে অর্ধেক রাতে এশার সময় শেষ হয়। তবে যদি কেউ জরুরি কোনো কারণে এ সময়ে এশা আদায় করতে না পারে তবে ফজরের আগে যে কোনো সময়েই এশার নামাজ আদায় করা বৈধ।
> এশার সময় শুরু হওয়ার পর থেকে সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত আদায় করা যায়। তবে এশার নামাজ বিলম্ব করে রাতের তৃতীয়াংশ হওয়ার আগে আদায় করা মোস্তাহাব। আর তাহাজ্জুদ নামাজে অভ্যস্ত ব্যক্তির জন্য বিতর নামাজ দেরি করে শেষ রাতে আদায় করাও মোস্তাহাব। যদি শেষ রাতে জাগ্রত হওয়ার ব্যাপার নিশ্চিত না হয় তবে ঘুমানোর আগে বিতর নামাজ আদায় করা উত্তম।
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জিবরিল আলাইহিস সালাম কাবা শরিফের চত্বরে দুইবার আমার নামাজে ইমামতি করেছেন। তিনি প্রথমবার জোহরের নামাজ আদায় করালেন যখন প্রতিটি জিনিসের ছায়া জুতার ফিতার মত ছিল। এরপর তিনি আসরের নামাজ আদায় করালেন যখন কোনো বস্তুর ছায়া তার সমান ছিল। এরপর মাগরিবের নামাজ আদায় করালেন যখন সূর্য ডুবে গেলো এবং যে সময়ে রোজাদার ইফতার করে।এরপর এশার নামাজ আদায় করালেন যখন লাল বর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপর ফজরের নামাজ আদায় করালেন যখন ভোর বিদ্যুতের মত আলোকিত হল এবং যে সময় রোজাদারের উপর পানাহার হারাম হয়।
তিনি (জিবরিল) দ্বিতীয় এবং আগের দিন ঠিক যে সময় আসরের নামাজ আদায় করেছিলেন। এরপর আসরের নামাজ আদায় করালেন যখন কোন বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হল। এরপর মাগরিবের নামাজ আদায় করালেন আগের দিনের সময়ে। এরপর এশার নামাজ আদায় করালেন যখন রাতের এক-তৃতীয়াংশ চলে গেল। আর ফজরের নামাজ আদায় করালেন যখন জমিন আলোকিত হয়ে গেল। এরপর জিবরিল আলাইহিস সালাম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
‘হে মুহাম্মাদ! এটাই হল আপনার আগের নবিদের (নামাজের) সময়। নামাজের সময় এই দুই সীমার মাঝখানে।’ (মিশকাত, আবু দাউদ, তিরমিজি)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ কোরআন-সুন্নাহ নির্ধারিত এ দুই সীমার মধ্যে পড়। প্রথম ওয়াক্তে নামাজ পড়ার প্রতি যত্নবান হওয়া। হাদিসের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আমলকরা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ফরজ নামাজগুলো যথাসময়ে পড়ার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।