১. নিশাবসান এর কবি নজরুল দ্রোহের চেতনা ব্যক্ত করতে যেয়ে তাঁর রচনায় যে তথ্য প্রত্যয়ের সাথে তুলে এনেছেন তা হলোতিনি কখনোই করুণা, সেবা, পূজার কবি ছিলেননা! বস্তুত তিনি প্রলয়ের, রুদ্রের, বীভৎস, মৃত্যু, ধ্বংস, ঘৃণা, ও যুদ্ধের–দ্রোহেরকবি। কবি নজরুল স্বদেশ চেতনায় নিজেকে মেলে ধরেছেন; এ সংবেদনশীল দ্রোহী কবি বিনম্র স্পর্শে নয়– আঘাতের কাঠিন্যদিয়ে স্বদেশ মুক্তির পথ খুঁজেছেন! জাতিকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দ্রোহের ‘অমর অক্ষয়‘ মন্ত্রে উদ্দীপিত করেএক নতুন জাগরণের অভিযাত্রায় ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষ সকলকে অভিযাত্রী হতে দুর্বার আহ্বান জানানোর চির উদ্যম তাঁর সাহিত্যেলক্ষ করা যায়। বাংলাসাহিত্যে ক্ষণজন্মা এ মেধাবী–সংবেদনশীল ‘মহাশঙ্খ‘ কবি নজরুলের বিস্ময়কর এ অসামান্য অবদানঅনস্বীকার্য! তিনি সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণের অনায়াস স্পর্ধা দেখিয়েছেন প্রাজ্ঞ মনস্বিতার সাথে। তাই এ অমর কবিকেদ্রোহের কবি, মানবতার কবি, জীবন বাস্তবতার কবি, এবং সব্যসাচী কবির অভিধায় অভিহিত করা হয়।
২. কবি নজরুলের কাব্যচেতনায় তাঁর সাঁচি সত্তার স্বচ্ছন্দতা– ক্রমাগত নির্বাধ উপস্থাপনে কবিতার পঙক্তিতে অনুস্যূত সত্য। এপ্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের শব্দিত উচ্চারণ ‘অদম্য স্বতঃস্ফূর্ততা নজরুলের রচনার প্রধান গুণ–এবং প্রধান দোষ‘! নজরুলের ‘চিন্তাহীনঅনর্গলতা‘ সম্পর্কে বায়রন (১৭৮৮–১৮২৪) এর কবিস্বভাবের বিভঙ্গ বিশ্লেষণে গ্যাটের (১৭৪৯–১৮৩২) উচ্চারিত অনুধ্যানেরপ্রতিধ্বনি–অনবদ্যতায় উদ্ভাসিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন ‘The moments he thinks, he is a child.’ (বুদ্ধদেব, ‘কালেরপুতুল‘, পৃ. ১৩০)। বুদ্বদেবের এ ধারার নিরীক্ষ্যমাণ পর্যবেক্ষণ– অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। সত্যেন্দ্রনাথকে (১৮৮২–১৯২২) নিয়ে ‘ফণিমনসা‘তে (১৯২৭) নজরুল-‘সত্যকবি‘ এবং ‘সত্যেন্দ্র প্রয়াণ গীতি‘ শীর্ষক দু‘টি কবিতা উপস্থাপন করেছেন যা কবিরভালোবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধায় বিজ্ঞাপিত–সত্যেন্দ্র প্রীতির পরিচয় জ্ঞাপক। সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় দ্রোহী কবিনজরুল গান্ধীজীর (১৮৬৯–১৯৪৮) অধ্যাত্মবাদী আদর্শেরও অনুগামী ছিলেন না। এমনকি গান্ধীজীর ‘অহিংসা পরম ধর্ম‘ কিংবা তার–ই ধারাবাহিক আন্দোলন–আদর্শের সপক্ষেও তাঁর ধনাত্মক অবস্থান লক্ষ করা যায় না! এ প্রাসঙ্গিক বিষয়টি তাঁর‘সব্যসাচী‘ কবিতায়ও সুব্যক্ত। নজরুলের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়;
‘সূতা দিয়ে মোরা স্বাধীনতা চাই, বসে বসে কাল গুণি!
জাগোরে জোয়ান! বাত ধ‘রে গেলো মিথ্যার তাঁত বুনি!
দক্ষিণ করে ছিড়িয়া শিকল, বাম করে বাণ হানি
এ–নিরস্ত্র বন্দীর দেশে হে যুগ শস্ত্রপাণি!…’
৩. নজরুল রচনা পর্যবেক্ষণে ওঠে আসে তাঁর বিদগ্ধ কবিমনের দ্রোহের স্বরলিপি; বাঁধভাঙ্গা প্রস্রবণের মতো সৃষ্টিনাশা আলোড়নতোলে– যা সমকালীন পুঁজিবাদী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক চিন্তা ও শোষণের উদ্দেশ্যকে কঠোরভাবে প্রহত করেছিলো।‘সর্বহারা”(১৯২৬) ‘আমার কৈফয়ত‘ শীর্ষক কবিতায় কবির বিধুনিত কবিভাষা নিঃসন্দেহে প্রজ্ঞাযুক্ত। বৈপ্লবিক আবেগেরপাশাপাশি মার্জিত ও পরিশীলিত জীবনবোধের অনন্য চিত্র উপস্থাপনে নিজেকে তুলে ধরেছেন এভাবে;
“বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী‘।
কবি ও অকবি যাহা বল মোরে, মুখ বুঁজে তাই সই সবই!” (আমার কৈফিয়ত)
নজরুলের কবিতায় উচ্চারিত প্রযুক্ত শব্দ বরাবরই সাম্যের, দারিদ্র্যের, উৎপীড়নের এবং দলিত ও ব্রাত্যজনের পক্ষে কবিরআপোষহীন অবস্থান নিশ্চিত করে। তাই সাম্যবাদী কবির কণ্ঠে নির্দ্বিধতায় শব্দিত হয়–
“গাহি সাম্যের গান–
যেখানে আসিয়া এক হ‘য়ে গেছে সব বাধা–ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু–বৌদ্ধ–মুসলিম–ক্রিশ্চান।” (‘সাম্যবাদী‘১৯২৪)
কবির এসকল অন্তর্ভেদী প্রসঙ্গ প্রান্তিক গণমানুষের এবং নিরন্ন জনগোষ্ঠীর চিরদুঃখের পাণ্ডুলিপি সফল উৎকর্ষজাত শৈল্পিকবিভায় উদ্ভাসিত। ‘ আমার কৈফিয়ত‘এ তাঁর বিদগ্ধ বিজ্ঞাপনে সেই অবিনাশী সুরই প্রতিধ্বনিত হতে দেখা যায়;
“পরোয়া করি না, বাঁচি বা না–বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে।
মাথার উপর জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক‘রো–যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস।
যেন লেখা হয় আমার রক্ত–লেখায় তাদের সর্বনাশ।
এ ধারায় নজরুলের দ্রোহী সত্তা এবং তাঁর নৈর্ব্যক্তিক চেতনা; স্বাতন্ত্র্য কবিস্বভাবের ব্যক্ত বিমূর্ত শক্তি, সমকালে দৃশ্যমান ধারায়উৎপীড়ক, জুলুমবাজের বিপক্ষে অবস্থান নেয়–এবং তাদের সর্বোচ্চ ধ্বংস কামনা করে। এ প্রসঙ্গে সমালোচক সঞ্জয় ভট্টাচার্যবলেন; ‘যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে কবি–সৈনিকের যা স্বাভাবিক পরিণতি, নজরুল ইসলামের তাই হয়েছিল। …কবি সৈনিক নজরুলইসলামের তাই কবি–বিদ্রোহী হয়ে ওঠা তাঁর জীবনেরই একটি যুক্তিযুক্ত পরিণতি।‘ (শ্রী সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ‘কবিনজরুল‘-১৯৫৭,পৃ.২৯)
৪. নজরুল চির তারুণ্যকে আবাহন করেছেন নিষ্ঠতায় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে। তাঁর ‘জিঞ্জির‘(১৩৩৫) এর ‘অগ্রপথিক‘ কবিতায়সেই প্রত্যয়ী সুর স্পন্দিত হয়েছে দক্ষতায়;
“নাগিনী–দশনা রণরঙ্গিণী শস্ত্রকর
তোর দেশ–মাতা, তাহারই পতাকা তুলিয়া ধর।”
বস্তুত ‘কৃষ্ণকণ্ঠ‘ কবি নজরুল তাঁর মন্থিত বিষ থেকে নিজেকে উৎসর্জন করতে চেয়েছেন স্বদেশ, মানুষ আর মানবতার জন্য।এরই ধারাবাহিক ক্রমায়ত–বিদ্যমান সমাজবাস্তবতায় চির আবেগের অন্তঃপুরে চিরউদ্দাম, চিরচঞ্চল অনুধ্যানগুলো দেশপ্রেম, দ্রোহ এবং পাশাপাশি মা, মটি,মানুষের প্রতি চিরপ্রেমের কোমলোজ্জ্বল অনুভূতি উদ্ভাসিত হতে দেখা যায়। এভাবেই তাঁর‘উচ্ছ্বসিত সৌন্দর্যপিপাসু কবিমনের‘ নন্দিত উদ্ভাস স্পষ্টীকৃত হয় কবিতার গীতিময় পঙক্তিতে। (শ্রী ভূদেব, ‘বাংলাসাহিত্যেরসংক্ষিপ্ত ইতিহাস‘,পৃ. ৩০৯)।
৫. ‘উচ্ছল‘ কবি–নজরুলের আবেগ থেকেই–তাঁর হাত ধরে বেরিয়ে আসলো চিত্তরঞ্জনের জন্য ‘চিত্তনামা‘! এর অব্যবহিত পরে, অসামান্য দক্ষতায়, অনায়াস অনবদ্যতার ছুঁয়ায় কালজয়ী অমর কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা‘(১৯২২); যা তাঁর দ্রোহের সন্দীপিত সত্তারঅনন্য দ্যোতক। বলা যায় আবেগের নৈর্ব্যক্তিকতায় কবিস্বভাবের অন্যতম এক দীপ্ত অভিব্যক্তি। অতঃপর তাঁর কবিচেতনারক্রমোৎকর্ষ–কবিতার অন্তঃপুরে অবাধ –অবিরাম জীবন ও বাস্তবতার নিরীক্ষিত আলেখ্যকে তুলে ধরে। রচনায় তুলে আনেনসময়ের দৃশ্যমান যত চিত্র! অনুভবের ধারাবাহিকতায় কবি সমকালের ‘খিলাফত আন্দোলনের‘(১৯২০) সমকালীনসমাজবাস্তবতায় বিদ্যমান অনুষঙ্গগুলো তুলে ধরতে উপস্থাপন করেন ‘কামাল পাশা ‘(১৯২১) ‘শাত–ইল আরব‘(১৯২১) এরমতো অজর কবিতা; যেখানে নিষ্ঠতায় উপস্থাপিত হয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানবিক চিত্র। এখানে নজরুলহিন্দু–মুসলিমের মৈত্রী সাধনের চিত্রকে তুলে এনেছেন বিমূর্ত আবেগের নিত্য সত্যোপলব্ধির ভেতর এবং তা–অকৃপণ প্রকাশকরেছেন অসম্ভব দৃঢ়তার সাথে। বস্তুত নজরুলের ‘আবেগের আবেদনই তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য। (‘ হরপ্রসাদ, ‘কবিতার বিচিত্র কথা‘ পৃ.৩৬৫)।
৬.এ ধারায় সমকালের সাহিত্য পর্যালোচনায় ‘তিরিশ‘ এর কবিদের অনুসন্ধিৎসু কাব্য যাত্রায় তাঁদের আধুনিক কাব্যচর্চারমৌলিক উপলব্ধি রবীন্দ্রানুগামী বলে ধরে নেয়া হয়। নজরুল(১৮৯৯–১৯৭৬), যতীন্দ্র(১৮৮৭–১৯৫৪), প্রেমেন্দ্র(১৯০৪–১৯৮৮) প্রত্যেকেই‘ রবীন্দ্রানুরাগী এবং বাস্তব মানব–সংসারের অকপট সমালোচক। যতীন্দ্রনাথ ব্যঙ্গপরায়ণ,-নজরুলের ভঙ্গিটাউচ্ছ্বসিত,-প্রেমেন্দ্র –ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, জড়বিজ্ঞান, ইত্যাদি শাস্ত্র–সচেতন, অথচ স্বপ্নময়! তাছাড়া বিশেষ অর্থে, কবিতার শিল্পকর্মে তিনি–ই রবীন্দ্র–যুগের সেই প্রথম আধুনিক কবি–যাঁর সঙ্গে আধুনিকতম বাংলার কাব্যরীতির প্রেরণাগত যোগআছে।‘(হরপ্রসাদ, ঐ, পৃ.৩৬৫)। নান্দনিক কবি জীবনানন্দ(১৮৯৯–১৯৫৪) এবং যতীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কালে বাংলারকাব্যজগতে নজরুলের হঠাৎ তাৎপর্যময় অবতরণ নন্দনতাত্ত্বিক শৈল্পিক উৎকর্ষকে দীপ্তকীর্তিতে উদ্ভাসিত করে। এ ধারায়নবাগত সমাকালের–অপর নন্দিত মেধাবী কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রকে অবশ্যই স্মরণ করতে হবে। বস্তুত ‘কৃষ্ণ কণ্ঠ‘ নজরুল সমকালীনজীবন বাস্তবতায় কঠিন সত্যকে গ্রহণ করেছেন সরল–সহজ অনুচিন্তনে। রূঢ় বাস্তবতাকে আমাদের কবি অভ্যর্থনা জানিয়েছেনকঠিন ‘সত্য‘কে অনুসন্ধানের লক্ষ্যে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে(১৯১৪) সৈনিকের স্বপ্নপ্রয়াস বস্তুত নজরুলের অনৃত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধেএবং আত্মমুক্তির নিরন্তর ইচ্ছের আবেগময়–যাপিত জীবনের প্রথম দ্রোহের নিরঙ্কুশ দলিল। অবহেলা আর দারিদ্র্যের প্রাসঙ্গিকবাস্তবতায় বেড়ে ওঠা নজরুল ছিলেন চির উদ্দাম এবং চির চঞ্চল! শৈশব থেকে সেই ন্যূনতম সুক্ষ্মসুখের প্রচল ধারায় কবিনিজেকে কখনো খুঁজে পাননি। সমকালীন প্রাসঙ্গিক এই প্রেক্ষিত যেনো নজরুলের নিয়তি!এখান থেকেই নজরুলের এ বিস্ময়করচেতনা অন্তর্বেদনায় নিমজ্জিত প্রক্ষোভের স্পন্দিত ধারায় উৎসন্নের যাত্রা করে। নজরুল সমকালে জীবনের অকোমল অভিজ্ঞানএবং অন্তর্ভেদী বোধের গভীরে–বহুদর্শিতায় আত্মদর্শী হয়ে ওঠেন। এখানেই নজরুল নিজেকে এক ব্যতিক্রমী ধারার কবি হিসেবেমেলে ধরে অসামান্য উচ্চতায় পৌঁছে যান। প্রজ্ঞার দীপ্তিময় চেতনার সন্দীপন তাঁর কবিচেতনার উদ্দীপনা– ক্রমশ কবিচিত্তেরঅজেয় প্রাণশক্তি– দৃশ্যমান জীবন বাস্তবতায় নিরন্তর অন্তরে তাঁর নির্বাধ ক্রোধ, দ্রোহ–উচ্ছ্বাসের সহাবস্থানে সংস্থিত হতে দেখাযায়।
বস্তুত নজরুলের অনন্য কবিসত্তার নিরীক্ষিত স্বরূপ কখনোই অদৃশ্যমান ছিলো না। তিনি ছিলেন সমকালীন কাব্যচর্চায় একনতুন দিগন্তের অভিযাত্রী। অতঃপর নজরুল হয়ে ওঠেন বাংলাসাহিত্যের ‘নিশাবসান‘ এর কবি।
৭. সমকালে নজরুল তাঁর বহুমাত্রিক কাব্যপ্রতিভার শ্রেষ্ঠত্বের অসামান্য স্বাক্ষর রাখেন তদানীন্তন ‘মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা‘ – ‘মোসলেম ভারত‘ ও ‘প্রবাসী‘ সাহিত্য পত্রিকায় বিরামহীন লেখা প্রকাশের মাধ্যমে। নজুরুল সাহিত্য পর্যবেক্ষণে জানা যায় তিনিকুড়ি বছর বয়স থেকেই বিশুদ্ধ কাব্যচর্চা শুরু করেছিলেন। তাঁর লেখা প্রথম কবিতা ‘মুক্তি‘ প্রকাশ পেয়েছিলো ১৯১৯ এ।কবিতার দীক্ষিত উপলব্ধির ধারায় নজরুল স্বীয় প্রতিভার অনন্য স্মারক নিয়ে অভিষিক্ত হন ১৯২১ এ ‘বিদ্রোহী‘ কাব্যগ্রন্থপ্রকাশের মাধ্যমে।এটি তাঁকে ‘অগ্নি–ঋষি‘র খ্যাতি এনে দেয় এবং পৌঁছে দেয় এক অতুল উচ্চতায়। এ কাব্যগ্রন্থ–ই তাঁকেচিরকালীন ‘বিদ্রোহী‘ অভিধায় তাঁর বহুমাত্রিক কবিপরিচয়কে অভিব্যাপ্ত করে। এ প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ বলেন ‘নজরুলের হাবিলদারপরিচয়টুকুও বাংলা কবিতার পাঠককে আকর্ষণ করেছে।‘(হরপ্রসাদ, ঐ, পৃ.৩১৪)। উল্লেখ্য সমকালে এ বলয়ের মেধাবীলেখকগোষ্ঠী রবীন্দ্র–অনুগামী ছিলেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে(১৮৬১–১৯৪১) কুলীন ভাবধারার অভিজাত কবি হিসেবেঅভিযোজিত করতেন। সাহিত্য চর্চার সমকালীন প্রেক্ষিত বিবেচনায় যতীন্দ্রনাথ, নজরুল, এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রেরনৈর্ব্যক্তিক(Impersonal) কবিসত্তার সাধর্ম্য বিবেচনায় প্রাজ্ঞ উপলব্ধির যে প্রাসঙ্গিক সমঞ্জস ছিলো–সে সম্পর্কে কারো কোনোদ্বিমত নেই। আর এখান থেকেই তাঁরা হয়ে ওঠেন প্রান্তিক জনমানুষের কবি। কবিতায় তাঁদের বস্তুনিষ্ঠ ও বলিষ্ঠ অনুভবেরউপস্থাপন, বিষয় ও ভাবনায় সংশ্লেষিত মনস্বী উপলব্ধি–বরাবর সাধারণ মানুষের পক্ষে–ই ছিলো। তাঁদের কবিতার গীতিময়পঙ্ক্তিতে অনুরণিত হয় গণমানুষের দুঃখ–কষ্ট, আকাঙ্ক্ষা ও নিপীড়ন–নির্যাতনের ‘রক্ত দিয়ে‘ লেখা জীবনের করুণ অধ্যায়! ‘নজরুল গাইলেন মানুষের বন্ধন–মেচনের গান। শব্দ–ছন্দ–ভাষার বিচিত্র ব্যবহারে তিনি ঘটালেন আটপৌরের সঙ্গে পোশাকিরমিল। তাঁর কবিতায় শোনা গেল দৃঢ় বিশ্বাসের অভিব্যক্তি। গগনচারী আধ্যাত্মিক বিশ্বাস নয়, দার্শনিক যুক্তিমগ্নতা মাত্র নয়– বাস্তব সংসারের স্বীকৃতি; সমস্ত ইন্দ্রিয়ের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি; দুঃখের উপলব্ধি থেকে দেখা দিলো নিশ্চিত জিগীষার সত্যবোধ।‘ (হরপ্রসাদ, ঐ,পৃ.৩১৪)।
লক্ষণীয় যে কাব্যজগতে দ্রোহী চেতনায় নজরুলের সমুত্থানের প্রায় দশ বছর আগেই যতীন্দ্র নাথের সফল কাব্য চরর্চার উন্মেষঘটে। আর তাঁর কবিতায় ওঠে আসে সমকালীন জীবন বাস্তবতার নৈরাশ্য–বেদনার বিষণ্ণ সুর! এমনকি সমকালে রবীন্দ্রনাথেরঅতীন্দ্রিয়–বীক্ষণীয় সেই রাবেন্দ্রীক চেতনার প্রভাববলয় থেকে তারুণ্যে উজ্জীবিত আধুনিক তরুণ কবিদের ধার্ষ্ট্যতায় বেড়িয়েআসার এক দৃশ্যমান চেতনাগত বাস্তবতার মেধাবী প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। নজরুলের দ্রোহের অনুভূতি বীক্ষিত ধারায় উচ্চারিত‘বিদ্রোহী–সুত‘ তাঁর কণ্ঠেই শব্দিত হয় নির্বাধ আবেগে। বস্তুত বাংলা কাব্যধারায় যতীন্দ্র নাথের উদ্দীপ্ত বিচরণ ১৩১৬ থেকে১৩১৭ সালে। অন্যদিকে এ ধারায় নজরুলের নিরীক্ষ্যমাণ উদ্দাম বিচরণ অতি নিষ্ঠতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩২৭ থেকে ১৩২৮সালে। একই যাত্রাপথে এক অভূতপূর্ব দ্যোতিত সত্তা নিয়ে কবিতার নান্দনিক অঙ্গনে নতুন সুরের লিরিক উপস্থাপনে অন্যতমসংবেদনশীল কবি জীবনানন্দের দেখা মেলে ১৩৩০ এর প্রায় সমান সময়ে।
৮. ১৩৩০ এ যতীন্দ্রনাথের ‘মরিচিকা‘, ১৯২২ এ নজরুলের ‘অগ্নিবীণা‘ এবং জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ‘ঝরাপালক‘(১৩৩৪) প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য সমকালে ‘প্রবাসী‘, ‘বঙ্গবাণী‘, ‘কল্লোল‘, ‘কালিকলম‘, ‘প্রগতি‘ ও ‘বিজলী‘ পত্রিকায়জীবনানন্দের কবিতা নিয়মিতই ছাপানো হতো।
নজরুলের সমকালে কাব্যচর্চার প্রথাগত বৃত্ত ভেঙ্গে বাইরে আসার পথটি বস্তুত কঠিনই ছিলো। কাব্যচর্চায় কিংবা অধুনাসাহিত্যের বিকাশে বিদ্যমান নানাবিধ অন্তরায়ের মধ্যেও সেসময় অনেক খ্যাতিমান পত্রিকাকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়।সাহিত্যের মৌলিক উৎকর্ষ সাধনে এগুলোর মধ্যে যাদের ভূমিকা সাহিত্যচর্চাকে একটি মেধাবী উচ্চতায় নিয়ে যেতে যে অসামান্য সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিলো সেগুলো যথাক্রমে ‘সবুজপত্র‘, ‘ভারতী‘, ‘মানসী‘ ও ‘মানসী মর্মবাণী‘ উল্লেখযোগ্য। কাব্যচর্চারসেকাল ততটা মসৃণ ছিলো না। এধারায় কিছু্কিছু শক্তিমান কবিগোষ্ঠী একটি নতুন ধারা তৈরিতে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।সমকালে কাব্যচর্চায় তাঁদের নিরীক্ষিত পথেই নতুন ও তরুণ কবিরা স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এরা মূলত পূর্বসূরিদেরঅনুগামী ছিলেন। সেসময় বাংলা কবিতার দুর্বল আঙিনায় অনুকরণ –অনুসরণের একরকম দিকভ্রান্ত অস্থিরতা বিরাজকরছিলো। আর তখন–ই এ অঙ্গনে নজরুলের আগমন। তিনি এলেন, জয় করলেন! সেই অস্থিরতার ভেতর প্রথার বাইরে এসেনিয়ম ভাঙ্গার কথা এই প্রথম উচ্চারিত হলো নজরুলের কণ্ঠে:
“নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া
‘আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া!’ ” (‘মোহররম‘ -‘অগ্নিবাণা‘র সর্বশেষ কবিতা)
৯. বাংলা সাহিত্যে কবি নজরুলের(১৮৯৯–১৯৭৬) স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ বিশশতকের দ্বীতিয় দশকে। সিজারের মতোই নজরুলএলেন দেখলেন জয় করলেন। ‘মুসলেম ভারতে‘(১৯২১) কবিতা প্রকাশের সাথে সাথে এজনপদের বাঙালি– এক নতুন শিল্পীরপ্রকাশভঙ্গির অনন্যতায় বিস্মিত ও মুগ্ধ। অদ্ভুত ছন্দমাধুর্য এবং বিপ্লবী চেতনায় সচকিত হয়ে নবীভূত বাঙালি দীপ্তিমান হয়েওঠে। এধারায় নজরুল হয়ে ওঠেন সমগ্র বিশ্বের, সমগ্র কালের,সমগ্র জাতির। যেমন – রোমারঁলা, তলস্তয়(১৮২৮–১৯১০), শেক্সপীয়ার(১৫৬৪–১৬১৬), গ্যাটে(১৭৪৯–১৮৩২), রবীন্দ্রনাথ(১৮৬১–১৯৪১) প্রমুখ। শিল্পীমাত্রই তাঁর রচনা বহুস্তরেরসৃজনকারী।
১০. নজরুল প্রথাগত ধারার বাইরে এসে নিজস্বতায় তাঁর সৃষ্টিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কবিতার প্রতি পঙক্তিতে উচ্চারিতসেই সত্যসুন্দরের আলোকিত স্পর্শে প্রমাণিত সত্য। তাই নজরুল মানুষের কবি, মানবতার কবি, নজরুল সাম্যের কবি, নজরুলপ্রেম ও দ্রোহের কবি। ‘ভাঙার গান‘এ নজরুলের সেই নবীভূত সুরের বিনয়ী উদ্ভাস লক্ষ করা যায়। কবির উচ্চারণ;
‘ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও…
দাও মনবতা ভিক্ষা দাও‘
বস্তুত প্রথা ভাঙ্গার জ্যোতির্ময় দিব্য নিয়ে নজরুল বাংলা সাহিত্যে দ্রোহর মৌলিক সংজ্ঞা সম্পাদনে নতুন দর্শন,নতুন উদ্দীপনবিনিশ্চিতকরণে পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা ও মনযোগ আকর্ষর্ণে নিজের দর্শনকে সুসম্পাদিত করতে পেরেছেন। নজরুলেরকাব্যচেতনা কিংবা তাঁর কাব্যপ্রজ্ঞার অসাধারণ সৃজনশক্তির প্রাসঙ্গিক মূল্যায়নে করুণাময় গোস্বামী দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন; ”Kazi Nazrul Islam known popularly as the ‘Rebel Poet’, made his marked appearance on the literary scene of Bengal in the middle of 1920,…”
১১. নজরুলের কবিসত্তার মূল্যায়নে সমকালীন বোদ্ধা সমালোচকগণ তাত্ত্বিক ভাবধারার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের প্রয়াস সমালোচকবিমল মুখোপাধ্যায়ের অনুধ্যানে ওঠে এসেছে। তিনি বলেন;’ সুপ্ত আগ্নেয়গিরির অন্তরজ্বালার যেদিন প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে, সেদিন লাভাস্রোতে দিগ্বিদিক নতুন ভয়ঙ্কর–সুন্দর এক বর্ণ ধারণ করে। বাঙালির অন্তরের সেই প্রচন্ড ‘জালার‘ রুপ আমরাদেখেছিলাম নজরুলের কাব্যে। স্বভাব কবির স্বাভাবিক সৌন্দর্য সৃষ্টির এ বিস্ময়কর ক্ষমতা নিয়ে নজরুলের আবির্ভাব বলেনজরুলের আবেদন সরাসরি অন্তরের কাছে।‘
১২. নজরুলের কবিতায় প্রেম ও দ্রোহ সমানভাবে বিদ্যমান। কবিতায় উপস্থাপিত দ্রোহের দৃশ্যমানতা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থারবিরুদ্ধে কবির প্ররত্যয়ী অবস্থানকে নিশ্চিত করে। বলা চলে তাঁর এ দ্রোহ স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে প্রথাভাঙ্গার দ্রোহ। কালজয়ী‘বিদ্রোহী‘(১৯২২) কবিতা নজরুলের কাব্যদর্শনও সমকালের চলমান ব্যবস্থায় বিনির্ণিত জীবনাদর্শনের অন্বর্থ দলিল। নজরুলেরকবিতায় অনুস্যূত হয়েছে জীবনের অনুপুঙ্খ বৈরী অভিজ্ঞতা এবং নিষ্ঠতার সাথে দ্রোহের অনুদ্গত কারণও অনায়াস ব্যক্তকরেছেন। বস্তুত নজরুলের কবিতায় বিদ্যমান দ্রোহের বিক্ষণীয় চেতনার শিরোনাম ‘বিদ্রোহী‘। কবিতায় উপস্থাপিত বিদ্যমানদ্রোহের দীপ্তঝংকার নজরুলের কবিসত্তায় উদ্দীপিত দ্রোহের চেতনা আমাদের চলমান জীবনের দৃশ্যমান বাস্তবতায় তীব্রভাবেহৃদয়ের অতলান্তিক গভীরে অদৃশ্য কম্পনে স্পন্দিত করে আলোড়ন তুলে;
‘মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত…
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ–ভূমে রণিবে না…’
১৩. সাম্য ও মানবতার কবি নজরুল। তারঁ দ্রোহ সাম্রাজ্যবাদ ও উপিবেশবাদের বিরুদ্ধে। সমকালের অত্যাচারীর বিরুদ্ধেনজরুল ছিলেন উচ্চকণ্ঠ এক সংশপ্তক।সমকালীন সমাজ ব্যবস্থায় সুশাসনের পরিবর্তে নিবর্তনমূলক বিধি প্রয়োগে সৃজ্যমানবৈষম্য তাঁর চেতনার পরিপন্থী।জীবনবাস্তবতায় ক্রমাগত নিপীড়ন, নির্যাতন তাঁর দ্রোহের চেতনাকে নির্বাধ গতিশীল করে তুলে।এরই ধারাবাহিক চেতনা প্রবাহে বীক্ষণীয় এবং নীরিক্ষিত কাব্যদর্শনে পরিবর্তিত দ্রোহের অন্তর্ভেদী সুর ‘আমার কৈফিয়ত‘ শীর্ষককবিতায় ওঠে এসেছে ;
‘বন্ধুগো! আর বলিতে পারিনা, বড় বিষজ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া খেলিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে
রক্ত ঝরাতে পারিনাতো একা
তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা…
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে।‘
বস্তুত নজরুল ‘আগুন খেলার সোনার বাংলা‘র কবি। অবিনাশী অদৃশ্য এক মহাশক্তি থেকেউল্লিখিত নজরুলের স্বদেশপ্রেম‘অব্যক্ত মহাশক্তিকেই‘ নির্দেশ করে।বহুদর্শী ‘ সৃজন– বেদনার‘ কবি নজরুল ব্রিটিশ – সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে অপশাসনমুক্তকরে সাম্যবাদের চেতনায় দেশকে বিনির্মাণে গণমানুষকে এগিয়ে আসার জন্যে দ্রোহের নৈর্ব্যক্তিক চেতনার মূল মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতেচেয়েছেন। এ বিষয়টি তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে সমানভাবে– সমান দক্ষতায় তুলে ধরার প্রয়াসটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।নজরুল এ বাংলাকে আবেগ দিয়ে নয়, শক্তি ও প্রচন্ডতা এবং আত্মপ্রত্যয়ের বলিষ্ঠতা নিয়ে সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্নদেখেছেন। নজরুল সমকালীন জীবনবাস্তবতায়–প্রেক্ষিত বিবেচনায় জাতিকে ঐক্যের ও স্বাধীনতার আহ্বান জানান। স্বপ্নদ্রষ্টা কবিবার বার জীবনকে উৎসর্গ করতে চেয়েছেন অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদ, মানবতাবাদ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তাই সাম্যের কবিনজরুলের কণ্ঠে শব্দিত হয়;
‘গাহি সাম্যের গান..
যেখানে আসিয়া এক হ‘য়ে গেছে সব বাধা–ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু– বৌদ্ধ– মুসলিম– ক্রীশ্চান।
আসলে নজরুলের দ্রোহের পরিব্যাপ্তি পরিমাপের কোন সীমারেখা ছিলনা। অসীমের দিকে দিগন্ত প্রসারিত সে বিদ্রোহনিঃসংকোচে নিঃশঙ্ক প্রবাহিত।
১৪. ‘নিশাবসানের‘ কবি নজরুল দ্রোহের চেতনা ব্যক্ত করতে যেয়ে তাঁর রচনায় যে তথ্য প্রত্যয়ের সাথে স্পষ্ঠীকৃত করেছেন,তাহলো– তিনি কখনোই করুণা,সেবা,পূজা,দেবতা,কিংবা হাসির কবি ছিলেন না,- তিনি প্রলয়ের, রুদ্রের, বিভৎস, ধ্বংসের,যুদ্ধের… কবি। জাতিকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দ্রোহের ‘অমর অক্ষয়‘ মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করে এক নতুন জাগরণেরঅভিযাত্রায় সকলকে অভিযাত্রী হতে দূর্বার আহ্বান জানিয়েছেন।
১৫. সব্যসাচী কবি নজরুল দ্রোহের, সাম্যের, প্রেমের এবং মানুষের কবি, আমাদের জাতীয় কবি। বাংলা সাহিত্যে এ সংবেদনশীল‘মহাশঙ্খ‘ কবি নজরুলের বিস্ময়কর অবদান চিরদিন অমর অক্ষয় হয়ে থাকবে।
১৬. বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। ‘মোসলেমভারত‘এ(১৯২১) কবিতা প্রকাশের সাথে সাথেএ জনপদের বাঙালি এক নতুন শিল্পীর প্রকাশভঙ্গীর অনন্যতায় বিস্মিত ও মুগ্ধ। অদ্ভুত ছন্দ মাধুর্য এবং বিপ্লবী চেতনায়সচকিত হয়ে নবীভূত বাঙালি দীপ্তিমান হওয়ার প্রয়াস পায়। বস্তুত কোন মহৎ শিল্পী–ই কোন একটা বিশেষ সম্প্রদায়,জাতি, কিংবা দেশের নন। এ ধারায় নজরুল সমগ্র বিশ্বের,সমগ্র কালের, সমগ্র জাতির। যেমন রোমা রলাঁ, তলস্তয়(১৮২৮–১৯১০), শেক্সপিয়ার (১৫৬৪–১৬১৬), গ্যাটে(১৭৪৯–১৮৩২), রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১–১৯৪১), নজরুল ইসলাম(১৮৯৯–১৯৭৬) প্রমুখ।শিল্পী মাত্রই তাঁর রচনা বহুস্তরের সৃজনকারী। কবি নজরুল তাঁর অসামান্য দক্ষতায় প্রথাগত ধারার বাইরে এসে সম্পূর্ণনিজস্বতায় তাঁর সৃষ্টিকে অনন্যমাত্রা প্রদানে সফল প্রয়াস পেয়েছেন। কবিতার প্রতি পঙক্তিতে উচ্চারিত সেই সত্য–সুন্দরেরআলোকিত স্পর্শ আমাদের মুগ্ধ করে। তাই নজরুল মানুষের কবি,মানবতার কবি। ‘ভাঙার গান‘ এ নজরুলের সেই অনুচিন্তনেরবিনয়ী উদ্ভাস লক্ষ্য করা যায়। ‘ভিক্ষা দাও…মানবতা ভিক্ষা দাও‘। অত্যাচারের বিরুদ্ধে দ্রোহের কবি নজরুল ‘নিপীড়িতমানবতার সপক্ষে মুক্তি আন্দোলনের তূর্যবাদক অগ্রসেনানী‘ ঐতিহাসিক বিপ্লবের প্রবাহমান সমকালীন বাস্তবতারধারাবাহিকতায় দৃশ্যমান অস্থিরতার দূর অপগত শতকটির দ্বিতীয় দশক নজরুল মানসে এক অভিনব ও অনপণেয় দ্রোহেরস্পর্শে অভিযোজিত হয়ে তাঁর কাব্যচেতনায় নতুন সুর নিরন্তর উদ্ভিন্ন হতে দেখা যায়; কবিতার সুবিন্যস্ত পঙক্তির মধ্যে।
১৭. প্রথা ভাঙার জ্যোতির্ময় দিব্য নিয়ে নজরুল বাংলা সাহিত্যে দ্রোহের মৌলিক সংজ্ঞা সম্পাদনে নতুন দর্শন, নতুন উদ্দীপনবিনিশ্চিতকরণে পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা ও মনোযোগ আকর্ষণে নিজের দর্শনকে সুসম্পাদিত করতে পেরেছিলেন। নজরুলেরকাব্যচেতনা কিংবা তাঁর কাব্যপ্রজ্ঞার অসাধারণ সৃজনশক্তির মূল্যায়নে করুণাময় গোস্বামী ( নজরুল গবেষক) লিখেন; “Kazi Nazrul Islam, known popularly as the ‘Rebel poet’, made his marked appearance on the literary scene of Bengal in the middle of 1920 when he came to Calcutta… joined as a soldier was disbanded at the end of the first World War. He was certainly not a newcomer to the literary domain. … literary scene of Bengal- Kazi Nazrul Islam was recognised to stand for a new voice in Tagore’s age.Nazrul succeeded in beginning like this and continuing this individual trend throughout his creative life not only in poetry but also in other forms of literary ventures together with a vast number of musical compositions.”
১৮. উল্লেখ্য ১৩২৭ এর ‘ মোসলেম ভারত‘ এ(১৯২১) হাফিজের গজল ‘যোসোফ গাম গশতা বাজ আয়েদ বা –কিনান গমমখোর‘ অবলম্বনে প্রকাশ পায় নজরুলের ‘বোধন‘ (১৩২৭)কবিতা। একই সংখ্যায় বের হয় ‘শাত্– ইল – আরব‘ (১৯২১)।আষাঢ় সংখ্যায় তিনি লিখেন হাফিজের ভাব ও ছন্দ নিয়ে ‘বাদল প্রাতের শরাব‘(১৯২১) কবিতাটি। শ্রাবণ সংখ্যায় বের হলো‘খেয়াপারের তরণী‘(১৯২১)। ভাদ্রে বের হয় ‘কোরবানি‘ (১৯২১), আশ্বিন সংখ্যায় বের হয় ‘মোহররম‘(১৯২১), ‘কামালপাশা‘ (১৯২১), তারপর বের হয় নজরুলের কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী‘(১৯২২) এ ধারায় ক্রমাগত বেরুতে থাকলো‘আনোয়ারপাশা‘(১৯২২), ‘ফাতেহা–ই– দোয়াজদাহাম ‘(১৯২২)।
বস্তুত নজরুলের ব্যতিক্রমী ও বহুমাত্রিক–মেধাবী কাব্যপ্রতিভার বহুদর্শিতায় এবং সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর বিদগ্ধ বিচরণসমকালে বাংলাসাহিত্যের প্রাজ্ঞ সমালোচকদের চমকে দিয়েছিলো!!
ড.এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ। বাংলাদেশ