নতুন করে করোনা মহামারীর প্রকোপ বাড়ার শঙ্কা মাথায় নিয়েই আগামীকাল রবিবার উদযাপিত হতে যাচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। গত মে মাসে ঈদুল ফিতরের সময় করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকায় যে স্বস্তিতে সবাই ঈদ উদযাপন করেছে, এবার তাতে কিছুটা ছেদ পড়ছে। এ অবস্থায় আবার ঈদের নামাজ আদায়ে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। মাস্ক পরিধানসহ এক কাতার ফাঁকা রেখে নামাজে দাঁড়াতে নির্দেশনা দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
করোনার মহামারীর আশঙ্কার পাশাপাশি এবার যোগ হয়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি বিস্তীর্ণ এলাকা দুদফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে এবার ঈদ উৎসবে ভাটা পড়বে। পাশাপাশি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ছাপ পড়তে শুরু করেছে সবখানেই। সব মিলিয়ে এবার
ঈদুল আজহার উৎসবের জৌলুস কিছুটা হলেও কমবে বলে ধারণা সবার মাঝে। ঈদ উপলক্ষে রাজধানী ছেড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। গ্রামে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে তাদের এই ছুটে চলা।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসী ও সারাবিশ্বের মুসলমানদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। পৃথক বাণীতে তারা মুসলিম উম্মাহর অব্যাহত শান্তি, সমৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনা করেছেন।
বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, মহান আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহা উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে চরম ত্যাগ ও প্রভুপ্রেমের পরাকাষ্ঠা। মহান আল্লাহর নির্দেশে স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাইলকে (আ) কোরবানি করতে উদ্যত হয়ে হযরত ইব্রাহিম (আ) আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, অবিচল আনুগত্য ও অসীম আত্মত্যাগের যে সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা ইতিহাসে অতুলনীয়। কোরবানি আমাদের মাঝে আত্মদান ও আত্মত্যাগের মানসিকতা সঞ্চারিত করে, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার মনোভাব ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে পবিত্র ঈদুল আজহার মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকল্যাণমুখী কাজে অংশ নিয়ে বৈষম্যহীন, সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমি প্রত্যাশা করি, প্রতিবারের মতো এবারও ঈদ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জীবনে সুখ ও আনন্দের বার্তা বয়ে আনবে।
রাজধানীতে ঈদের জামাত : জাতীয় ঈদগাহে পবিত্র ঈদুল আজহার প্রধান জামাত সকাল ৮টায় অনুষ্ঠিত হবে। গত বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এবার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে পাঁচটি জামাত অনুষ্ঠিত হবে। প্রথমটি হবে সকাল ৭টায়। গত বুধবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানায়, বায়তুল মোকাররমে ঈদের দিন সকাল ৭টায় প্রথম, ৮টায় দ্বিতীয়, ৯টায় তৃতীয়, ১০টায় চতুর্থ ও ১০টা ৪৫ মিনিটে পঞ্চম দফায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম জামাতে ইমামতি করবেন বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান। মুকাব্বির থাকবেন বায়তুল মোকাররম মসজিদের মুকাব্বির হাফেজ মো. আতাউর রহমান। দ্বিতীয় জামাতে ইমাম থাকবেন বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মুহিবুল্লাহিল বাকী নদভী। মুকাব্বির থাকবেন বায়তুল মোকাররমের সাবেক মুয়াজ্জিন হাফেজ মো. আব্দুল হাদী। তৃতীয় জামাতের ইমাম থাকবেন ড. মাওলানা আবু সালেহ পাটোয়ারী। হাফেজ মো. শহিদ উল্লাহ এই জামাতের মুকাব্বির থাকবেন। চতুর্থ জামাতে ইমাম থাকবেন বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মাওলানা মুহিউদ্দিন কাসেম। মুকাব্বির থাকবেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খাদেম মো. জহিরুল ইসলাম। পঞ্চম ও সর্বশেষ জামাত অনুষ্ঠিত হবে ১০টা ৪৫ মিনিটে। এতে ইমাম থাকবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। মুকাব্বির হবেন খাদেম মো. রুহুল আমিন। পাঁচটি জামাতে কোনো ইমাম অনুপস্থিত থাকলে বিকল্প ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি মাওলানা মো. আব্দুল্লাহ।
রাজধানীর পাশাপাশি যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে সারাদেশে মুসলিম সম্প্রদায় ঈদুল আজহা উদযাপন করবে। করোনা ভাইরাস মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ শেষে মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া কামনা করা হবে। মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহ লাভের আশায় ঈদুল আজহার জামাত শেষে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করবেন। সারাদেশে বিভাগ, জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এবং সরকারি সংস্থাসমূহের প্রধানরা জাতীয় কর্মসূচির আলোকে নিজ নিজ কর্মসূচি প্রণয়ন করে ঈদ উদযাপন করবেন।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি গণমাধ্যমসমূহ যথাযোগ্য গুরুত্বসহকারে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার ও সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবে। ঈদ উদযাপন উপলক্ষে দেশের সব হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশুসদন, বৃদ্ধাশ্রম, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনসমূহে যথাযথভাবে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন করবে। এ উপলক্ষে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রক্ষার্থে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কোরবানির পশুর রক্ত বা বর্জ্য পদার্থ দ্বারা যেন পরিবেশ দুর্গন্ধময় না হয়, সে বিষয়ে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। ঈদুল আজহার পূর্ববর্তী জুমার খুতবায় এ বিষয়ে মুসল্লিদের সচেতন করা হয়েছে।
প্রায় চার হাজার বছর আগে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ) নিজ পুত্র হযরত ইসমাইলকে (আ) কোরবানি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরম করুণাময়ের অপার কুদরতে হযরত ইসমাইল (আ)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর ত্যাগের মহিমার কথা স্মরণ করে বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায় জিলহজ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহপাকের অনুগ্রহ লাভের আশায় পশু কোরবানি করে থাকে।
আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য আল্লাহ কোরবানি ফরজ করে দিয়েছেন। এজন্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি করাই এ দিনের উত্তম ইবাদত। সেই ত্যাগ ও আনুগত্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সারাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় রবিবার দিনের শুরুতেই মসজিদে সমবেত হবেন এবং ঈদুল আজহার দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করবেন। নামাজের খুতবায় খতিব তুলে ধরবেন কোরবানির তাৎপর্য। তবে এবার করোনার পাশাপাশি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে ভিন্ন পরিবেশে কোরবানির ঈদ হওয়ায় অন্যান্য বারের চেয়ে পশু কোরবানি কিছুটা কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নামাজ শেষে মুসল্লিদের অনেকেই যাবেন কবরস্থানে। চিরবিদায় নেওয়া স্বজনদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সজল চোখে এই আনন্দের দিনে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে আল্লাহর দরবারে আকুতি জানাবেন।
জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা উদযাপিত হলেও পরের দুই দিনও পশু কোরবানি করার বিধান রয়েছে। সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি ফরজ হলেও ঈদের আনন্দ থেকে দরিদ্র-দুস্থরাও বঞ্চিত হবেন না। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির সমুদয় অর্থ এবং কোরবানি দেওয়া পশুর মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হবে। মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় এই উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দও দেশবাসীকে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশু কোরবানির জন্য নগরবাসীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে উভয় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোরবানির পশুর বর্জ্য দ্রুত অপসারণের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুই সিটি করপোরেশনের প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বর্জ্য অপসারণে নিয়োজিত থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।