আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড় পেতে বাংলাদেশকে যেসব শর্ত দিয়েছিল সংস্থাটি, সেই সবের মধ্যে রাজস্ব আহরণের শর্ত পূরণ হয়নি। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমানোর প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা কমানো সম্ভব হয়নি বরং আরও বেড়েছে। অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে এ দুটি বিষয় বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তদুপরি, অন্তর্বর্তী সরকার আইএমএফের পরামর্শে আর্থিক খাতের সংস্কারে যেসব নীতি-উদ্যোগ নিয়েছে, পরবর্তীকালে নির্বাচিত সরকার এসে সেগুলো অব্যাহত রাখবে কি নাÑ এ নিয়েও সংশয়ে আছে সংস্থাটি। সংস্কার কর্মসূচির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে নতুন নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আলোচনা শেষে ঋণের পরবর্তী কিস্তির অর্থ ছাড় করতে চায় আইএমএফ।
গত ২৯ অক্টোবর থেকে ঢাকায় সফর করছে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল। দলটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বৈঠক করছে। এসব বৈঠকে অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন আইএমএফ কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনারও পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম রাজস্ব আহরণ বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে দলটি। খেলাপি ঋণের পরিমাণও লাগামহীনভাবে বাড়ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আগামী বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমানোর প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।
সভায় অংশ নেওয়া অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব আমাদের সময়কে বলেন, কর জিডিপি রেশিও বৃদ্ধিতে সরকার ব্যর্থ হওয়ায় আইএমএফ মনে করছে, রাজস্ব খাতের সংস্কার এখনও সঠিক পথে আসেনি। এ ছাড়া নির্বাচিত সরকার এসে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলো মেনে নেবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এ ছাড়া আমরা খারাপ ঋণ কীভাবে কমাব, এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন, ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছে আইএমএফ। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী ৬ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করবে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। ১১ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে তাদের বৈঠক করার কথা রয়েছে। এ ছাড়া ১২ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ প্রেসব্রিফিং করার কথা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, আইএমএফের দেওয়া শর্তগুলোর বেশিরভাগই পূরণ করেছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, রিজার্ভ সংরক্ষণ ও বকেয়া বিল এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধ, আর্থিক খাতের নানারকম সংস্কারে বাংলাদেশ গত এক বছরে অভাবনীয় কিছু কাজ করেছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ এনবিআরকে বিলুপ্ত করে পৃথক দুটি বিভাগ চালু করা। তবে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমার চেয়ে আরও অনেক বেড়েছে।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মূল্যস্ফীতির হার ঝুঁকিমুক্ত করতে চলমান সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি রোধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চেয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে বাজারের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ বা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ডলার বেচাকেনা বন্ধ করতে বলেছে।
বৈঠকে আইএমএফ বলেছে, মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশের নিচে না আসা পর্যন্ত চলমান সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। এখন মুদ্রানীতি শিথিল করা কোনোক্রমেই ঠিক হবে না। শিথিল করলে মূল্যস্ফীতির হার আবার বেড়ে যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, প্রায় ৪ বছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কর্মসংস্থানের গতি সংকোচিত হয়ে পড়েছে। কর্মসংস্থান বাড়াতে ও অর্থনীতি চাঙ্গা করতে এখন বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যবসায়ীদের দিক থেকেও সুদের হার কমানোর প্রবল চাপ আছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, বর্তমানে খেলাপি ঋণের সব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া গত সরকারের আমলে অনিয়মের মাধ্যমে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোও খেলাপি হচ্ছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। খেলাপি ঋণ কমাতে কিছু নীতিসহায়তা দেওয়া হয়েছে। পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ আদায়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশের ভেতরে যেসব খেলাপি ঋণ রয়েছে, সেগুলো আদায়ের পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। আইএমএফ ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব ধরনের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হোক, এটা চায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েও হস্তক্ষেপ করছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এরপর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার এবং চলতি বছরের জুনে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩৩ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।