ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ার পর এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন ঘিরে বেশ নড়েচড়ে বসেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির মনোনীত প্যানেল এরই মধ্যে ৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে। ইশতেহারে শিক্ষা, গবেষণা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ও নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাসহ শিক্ষার্থীদের কল্যাণমূলক বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রচার।
ছাত্রদলের নেতারা বলছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের পরিস্থিতি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হবে না। ছাত্রদল অন্য দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুলত্রুটি শুধরে নতুন উদ্যমে কাজ চালাচ্ছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব অনিয়ম ফুটে উঠেছে, এসব এখানে না হলে ছাত্রদল জয়ের বিষয়ে আশাবাদী।
প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের বাস্তব চাহিদা বুঝে ইশতেহার তৈরি করেছি। শিক্ষার্থীদের অধিকার ও কল্যাণে আমাদের প্যানেল কাজ করবে। ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম। আর অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আমরা সব সময় আপসহীন ছিলাম। আমরা সব আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি। অতীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রোষানলের শিকার হয়ে আমি নিজেই মামলার প্রধান আসামিও হয়েছি। এবার চাকসুতে সুযোগ এসেছে নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে আরও শক্তভাবে থাকার। শিক্ষার্থীরা আমাদেরই নির্বাচিত করবেন বলে আশাবাদী।
জিএস প্রার্থী মো. শাফায়াত হোসেন বলেন, আমাদের সংগঠন হলো দাবি আদায়ের সংগঠন। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্যই রাজনীতি করি। আমরা আমাদের ইশতেহারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও চাওয়াগুলোই তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, শিক্ষার্থীদের চাওয়াই আমাদের ইশতেহার। যে ইশতেহারগুলো দিয়েছি, সেগুলো এক বছরের মধ্যেই পূরণ করতে পারব বলে আমরা বিশ্বাসী। আর শিক্ষার্থীরা এখন সচেতন। তারা যোগ্য প্রার্থী খুঁজেই ভোট দেবেন।
এজিএস প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিক বলেন, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি। আমাদের ইশতেহার সবার কাছে তুলে ধরছি। আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে যাওয়ার পর তাদের চাওয়াগুলো নোট করে নিই। আমরা শিক্ষার্থীদের সাড়া পাচ্ছি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আমরা জয়ের বিষয়ে আশাবাদী।
কী আছে ছাত্রদলের ইশতেহারে: ইশতেহারে বলা হয়েছে, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অনলাইন স্টুডেন্ট পোর্টাল চালু, ম্যাটল্যাব ও গবেষণা সফটওয়্যারের ব্যবস্থা, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখা, প্রতিটি হলে পাঠাগার স্থাপন এবং শহরের ২ নম্বর গেটে গ্রন্থাগারের শাখা খোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
একাডেমিক জটিলতা নিরসনে ওপেন ক্রেডিট সিস্টেম, ক্রেডিট ট্রান্সফার এবং সেশনজট কমানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য ভাতা বৃদ্ধি, ব্রেইল বই সরবরাহ ও হলে সিট সংরক্ষণের অঙ্গীকারও দেওয়া হয়েছে।
খাদ্য ও আবাসনে সুলভমূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সরবরাহ এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য ‘একটি সিট, একটি পড়ার টেবিল’ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্যানেলটি।
নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও কল্যাণে সিসিটিভি ক্যামেরা, হেল্পলাইন, আলোকসজ্জা বৃদ্ধি, সাইবার বুলিং ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা সেল গঠন, স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন, নারী চিকিৎসক ও সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর নিয়োগ এবং মেয়েদের হলে ফার্মেসি ও জিমনেশিয়াম স্থাপন করার উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
পরিবহনে শাটল ট্রেনের বগি বৃদ্ধি, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বগি সংযোজন, ই-কার ও বিশেষ বাস সার্ভিস চালু এবং ট্র্যাকিং অ্যাপ তৈরির ঘোষণা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় মেডিকেল সেন্টারকে ১০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীতকরণ, ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা, ব্লাড ব্যাংক এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এ ছাড়া সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার বিকাশে মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক গবেষণাকেন্দ্র, আন্তঃবিভাগ প্রতিযোগিতা, সুইমিংপুল ও জিমনেশিয়াম নির্মাণ এবং ক্যারিয়ার উন্নয়নে অন-ক্যাম্পাস জব, জব ফেয়ার, অ্যালামনাই বৃত্তি ও স্টার্টআপ সহায়তা কর্মসূচি চালুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি প্রচার করছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। প্রার্থীরা সকাল থেকে রাত অবধি ক্যাম্পাসের প্রতিটি জায়গা চষে বেড়াচ্ছেন। রেলস্টেশন থেকে ঝুপড়ি, কটেজ থেকে হল, এমনকি নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করছেন। পাশাপাশি অনলাইন প্রচারেও তারা সমানভাবে অংশ নিচ্ছেন। তারা ভোট চাইছেন, পরামর্শ নিচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, আমরা মনে করেছিলাম ৫ আগস্ট-পরবর্তী ক্যাম্পাসে দখলদারিত্বের অবসান হবে। বৈষম্যমুক্ত ক্যাম্পাস হবে; কিন্তু বাস্তবে আমরা সেটা দেখিনি। প্রভোস্ট বিশেষ বিবেচনায় শিবিরের নেতাদের হলে আসন বরাদ্দ দিয়েছেন। হলের ক্যান্টিনে খাবারের ক্ষেত্রে মিল সিস্টেমের নামে বৈষম্য হচ্ছে। আমরা এসবের অবসান চাই।
তিনি বলেন, ছাত্রদল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কখনোই আধিপত্য, খুন ও সহিংসতার রাজনীতি করেনি। ছাত্রদলের কারণে কখনোই ক্যাম্পাস বন্ধ হয়নি। নিয়োগ বা অন্যান্য অনৈতিক কিছুর সঙ্গে ছাত্রদল জড়িত ছিল না। অতীতে আমরা ক্যাম্পাসে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। ছাত্রলীগের নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেও রাজনীতি চালিয়ে গেছি। আমরা গুপ্ত থেকে রাজনীতি করেনি। এই বিষয়গুলো সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানেন।
সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাংগঠনিক টিমের প্রধান কাজী জিয়াউদ্দিন বাসেত কালবেলাকে বলেন, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় অনেক প্রশ্ন সামনে এসেছে। গণমাধ্যমে অনেক অনিয়ম ফুটে উঠেছে। তবে আমরা এগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। আমরা গণতন্ত্রের জয়যাত্রায় শামিল থাকতে চাই। দীর্ঘদিন পর ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের যে উৎসব শুরু হয়েছে, আমরা চাই এ ধারা অব্যাহত থাকুক। শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করুক। যে অনিয়মগুলো গণমাধ্যমে ফুটে উঠেছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয়।