ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর। এবার ডাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে মোট প্রার্থী ১ হাজার ৫৭০ জন। ২৬ আগস্ট থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর কথা থাকলেও এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করে দিয়েছেন প্রার্থীরা। সেখানে তারা শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করার অঙ্গীকার দিচ্ছেন। ইশতেহারে উঠে আসছে আবাসন সংকট নিরসন, ক্যান্টিনে ভর্তুকি, খাবারের মানোন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণসহ শিক্ষার্থীবান্ধব নানা প্রতিশ্রুতি। এতসব প্রতিশ্রুতির ভিড়ে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা—প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন যেন হয়।
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবারের ডাকসুতে মোট প্রার্থী ৪৬২ জন। হল সংসদ নির্বাচনে ১৮টি হলে প্রার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ১০৮ জন। ডাকসু নির্বাচনের কোনো প্যানেল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ইশতেহার ঘোষণা না করলেও হল সংসদের প্রার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ইশতেহার ঘোষণা করে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ইশতেহারে আবাসন সংকট নিরসন, ক্যান্টিনে ভর্তুকি নিশ্চিত ও খাবারের মান বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে।
স্বাস্থ্য ও আবাসন ছাত্রদলের প্রধান টার্গেট উল্লেখ করে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে ডাকসুর ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান কালবেলাকে বলেন, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, রেজাল্ট, গবেষণা, সহশিক্ষা, পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং দেশ পরিবেশে গড়ে তোলার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা আমরা করব। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হবে স্বাস্থ্য ও আবাসন। কারণ একজন শিক্ষার্থী প্রথমবর্ষে সুস্থ হয়ে ভর্তি হয়ে আসছে এবং সে যখন পড়াশোনা শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন সে অসুস্থ হয়ে বের হচ্ছে। সুতরাং স্বাস্থ্যের দিকটায় খেয়াল রাখতে হবে, যেন পুষ্টিকর খাদ্য এবং সুন্দর পরিবেশ বিরাজমান থাকে। আর দ্বিতীয় লক্ষ্য হলগুলো থেকে পরিপূর্ণ আবাসন সংকট দূর করে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দান করা।
নারীদের নিরাপত্তার অঙ্গীকার জানিয়ে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম বলেন, ‘আমাদের ম্যানিফেস্টোতে থাকবে—ছাত্রীদের সেফটি ও সিকিউরিটি জোরদার করা; গার্ডিয়ান লাউঞ্জ ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের প্রবেশের ব্যবস্থা; ক্যান্টিন ও হাইজিন সুবিধা উন্নত করা; রাতের জরুরি চিকিৎসা ও নারী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগ; নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার; সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় প্রশাসনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ। প্রতিজ্ঞা করছি, নারীদের জন্য একটি নিরাপদ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার এই পথযাত্রায় আমরা থামব না।’
এদিকে, নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে কথা হয় কবি জসীমউদ্দীন হল সংসদের ভিপি প্রার্থী ওসমান গনির সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘সর্বদা হলের শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার মনোভাব থেকে সব সময় তাদের সমস্যা বুঝে নানা বিষয়ে প্রশাসনের মাধ্যমে কাজ করার চেষ্টা করেছি। তাই হলে বিরাজমান নানা সমস্যা নিয়ে আমি ভালোভাবেই অবগত।’
তিনি বলেন, ‘সৎ উদ্যোগ ও কর্মপ্রচেষ্টা থাকলে কোনো কিছু বাধা হতে পারে না। এজন্য আমার ইশতেহারে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দিকটিকে প্রাধান্য দিয়েছি। এ ছাড়াও হলের সিট সংকটের সমাধানসহ বিদ্যমান নানা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে ইশতেহার সাজিয়েছি। শিক্ষার্থীদের সব সমস্যাকে অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করেছি।’
শিক্ষার্থীদের মনন বিকাশে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেসব সমাধানের লক্ষ্য নিয়েই ইশতেহার সাজাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিজয় একাত্তর হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী আশিক বিল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমাদের হলে প্রধানত তিনটি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। সিট বণ্টনে অস্বচ্ছতা, খাবারের মান ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ইশতেহার সাজানোর চেষ্টা করছি। এ ছাড়া হলের যাবতীয় সমস্যা তুলে আনার চেষ্টা করেছি। নির্বাচিত হলে এই প্রতিজ্ঞা রক্ষাই হবে আমার প্রধান কর্তব্য।’
এদিকে শিক্ষার্থীদের বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি তাদের জন্য নতুন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির বিষয়টি ইশতেহারে রাখছেন বলে জানিয়েছেন হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের এজিএস প্রার্থী আশিকুর রহমান সাকিব। তিনি বলেন, নির্বাচিত হলে অ্যালামনাইদের সঙ্গে সমন্বয় করে হলের শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণমূলক বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তাদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থা করা হবে।
হলে যাতে আর কোনোদিন ছাত্ররাজনীতি ঢুকতে না পারে, সেই প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন প্রার্থীদের কেউ কেউ। রোকেয়া হলের ভিপি প্রার্থী ফারজানা আক্তার আরজু কালবেলাকে বলেন, ‘রোকেয়া হলকে সব ধরনের দলীয় রাজনীতিমুক্ত রাখার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আমি ডাকসু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি, আমি আমার হলকে গোপন ও প্রকাশ্য রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীবান্ধব ও পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি এবং মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি স্বস্তির আবাস্থল নিশ্চিত করতে পারব। এ ছাড়া মেস সিস্টেম মিলের ব্যবস্থা করা, লেট গেট ১১টা পর্যন্ত সবার জন্য খোলা রাখা, ইমারজেন্সি কেসে (দুর্ঘটনা সাপেক্ষে) লেট গেট দিয়ে বের হওয়ার প্রসেসটা শিথিল করা, হলের প্রবেশগেট ডিজিটালাইজড করতে প্রশাসনকে বাধ্য করা এবং হলের চলমান অন্যতম সংকট—সিট বরাদ্দ, পানি, লিফট ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক সমস্যা সমাধান করা আমার ইশতেহারের অন্যতম লক্ষ্য।’
যা ভাবছেন ভোটাররা: নির্বাচনী ইশতেহার যাতে কেবল ফাঁকা বুলি না হয়, বরং নির্বাচনের পরে প্রার্থীরা যেন তা বাস্তবায়ন করেন, সেটাই প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থী সিফাত ভূঁইয়া বলেন, ‘অনেকে অতিরঞ্জিত ইশতেহার দিচ্ছে। এসব বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হবে। যারা ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে চায়, তারা ইশতেহার বাস্তবায়ন করবে বলে মনে করি।’
কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান বলেন, ‘ভোট চাইতে এসে অনেকেই অনেক কথা বলছেন, নানা প্রতিজ্ঞা করছেন। নির্বাচিত হলে সেই প্রতিজ্ঞা কতটা বাস্তবায়ন করবেন, সেটাই দেখার বিষয়। নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা ভোটারদের অনেক প্রতিশ্রুতি দেন; কিন্তু পরে তারা সেটা ভুলে যান। তবে ডাকসুর প্রার্থীরা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখবে বলে আমরা আশাবাদী।’
স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী তানভীর আনাস বলেন, ‘এই ডাকসু নির্বাচনের পেছনে একদিকে যেমন জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রার্থীরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই আমরা চাই, এমন একটি নির্বাচন হোক যে নির্বাচন পুরো বাংলাদেশের জন্য বেঞ্চমার্ক হয়ে থাকবে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে মেধাবীরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে পারবে, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে—এটাই আমাদের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা।’