দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার বাড়াতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনুমোদন পাওয়া ৫৪টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় ও বিদেশি যৌথ বিনিয়োগে প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য থাকলেও খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প সফল করতে হলে নিবিড় তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের মতে, আগের সরকারের সময়ের মতো দুর্বল পর্যবেক্ষণ, ভূমি-সংক্রান্ত ছাড়পত্রে জালিয়াতি এবং অংশগ্রহণকারীদের আর্থিক সক্ষমতা যাচাই না করলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার থাকতে হবে কমপক্ষে ৮ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল থাকতে হবে ৫৭ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি মেগাওয়াটের জন্য টেন্ডার সিকিউরিটি ধরা হয়েছে ৫ হাজার মার্কিন ডলার। জমি-সংক্রান্ত বিষয়ে স্থানীয় এসিল্যান্ড এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার ছাড়পত্র জমা দেওয়াও বাধ্যতামূলক। এজন্য সরকারের উচিত প্রতিটি প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা ও জমি-সংক্রান্ত নথি আলাদাভাবে যাচাই করা। যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতি মেগাওয়াট অনুযায়ী অর্থায়ন পর্যবেক্ষণও জরুরি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর অনিয়মের অভিযোগে আগের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনুমোদন পাওয়া ৩৭টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প স্থগিত করা হয়, যার প্রায়গুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল। একই প্রতিষ্ঠান একাধিক কেন্দ্রের অনুমোদন পাওয়ার পরও সক্ষমতার ঘাটতি যাতে না হয়, এজন্য নতুন দরপত্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা যাচাইয়ের শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম জানান, অনেক প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিয়েছে এবং ইভ্যালুয়েশন কাজ শুরু হয়েছে। একাধিক প্রকল্পে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও যাচাই-বাছাই শেষে বোঝা যাবে কে কাজ করতে পারবে আর কে পারবে না। তিনি আরও বলেন, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী জালিয়াতির প্রমাণ মিললে তা বাতিল করা হবে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে ৫ হাজার ২৩৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫৫টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চারটি টেন্ডার প্যাকেজ আহ্বান করা হয়। প্রথম ধাপে দুর্বল সাড়া মেলে, দ্বিতীয় ধাপে ১০টি প্লান্টের জন্য মাত্র ২১টি দরপত্র জমা পড়ে। কম সাড়ার কারণে সময়সীমা পাঁচবার বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় ধাপে বিপিডিবি ৪৬টি দরপত্রের নথি বিক্রি করলেও ১০টি প্রস্তাবিত সৌর প্লান্টের জন্য মাত্র ২১টি দরপত্র পায়। প্রতিটি প্লান্টের ক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট, মোট ৫০০ মেগাওয়াট।
দ্বিতীয় ধাপের টেন্ডার ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়, জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ১০ মার্চ। সাড়া কম পাওয়ায় সময়সীমা দুবার বাড়িয়ে ১৫ মে নির্ধারণ করা হয়, পরে আরও তিনবার পিছিয়ে ১৮ জুন দরপত্র খোলার দিন ঠিক হয়। নথি থেকে জানা যায়, এককভাবে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ২৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সর্বাধিক দরপত্র জমা দিয়েছে। এ ছাড়া দেশ এনার্জি ৯টি, কনফিডেন্স ৭টি, বারাকা ৬টি ও মীর ৫টি প্রকল্পের জন্য দরপত্র দিয়েছে।
কক্সবাজার (উত্তর) ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাব-স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত দুটি প্রস্তাবিত প্লান্টের জন্য ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, কর্ণফুলী-বারাকা শিকলবাহা কনসোর্টিয়াম এবং কনফিডেন্স পাওয়ার বগুড়া ইউনিট-২ লিমিটেড দরপত্র জমা দিয়েছে। গোপালগঞ্জের একটি প্লান্টের জন্য ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, দেশ এনার্জি চাঁদপুর পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং বিজনেস রিসার্চ ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন ইনক ও চাংঝু ট্রিনা ইন্টেলিজেন্স এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগ দরপত্র দিয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার একটি প্লান্টের জন্য ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড একমাত্র দরদাতা ছিল। জলঢাকার প্লান্টের জন্য ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, কনকর্ড প্রগতি কনসোর্টিয়াম লিমিটেড এবং পিনাকল ঝংবিংতাই ইন্টারন্যাশনাল বিডি লিমিটেড দরপত্র দিয়েছে। পঞ্চগড়ে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও কনফিডেন্স পাওয়ার বগুড়া ইউনিট-২ লিমিটেড দরপত্র জমা দিয়েছে। ফরিদপুরের প্লান্টের জন্য ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড একমাত্র দরদাতা।
বিবিয়ানা ২৩০/১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাব-স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত প্লান্টের জন্য পিএইচএল-পিটিএল জেভি (প্যারামাউন্ট), দেশ এনার্জি চাঁদপুর পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং এমটিএল-সিএইচআই-পিসিএল-এমএসএল জেভি দরপত্র জমা দিয়েছে। মুক্তাগাছা সাব-স্টেশনের প্লান্টের জন্য ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড একমাত্র দরদাতা, আর শাহজিবাজার সাব-স্টেশনের প্লান্টের জন্য এমটিএল-সিএইচআই-পিসিএল-এমএসএল জেভি একমাত্র দরদাতা।
খাত-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিদেশি বিনিয়োগ থাকা প্রকল্প স্থগিত করায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। পাশাপাশি নতুন দরপত্রে জমি-সংক্রান্ত শর্ত হিসেবে এসিল্যান্ডের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুদ্রার ঝুঁকি—দরপত্রে বলা হয়েছে, ৭০ শতাংশ অর্থ মার্কিন ডলারে এবং ৩০ শতাংশ বাংলাদেশি টাকায় দেওয়া হবে, তবে স্থানীয় মুদ্রার অংশে কোনো মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় থাকবে না। এসব বিবেচনায় অংশগ্রহণকারীদের প্রস্তাবনা সঠিকভাবে যাচাই না হলে উদ্যোগটি ব্যর্থ হতে পারে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) প্রধান জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, সরকার সৌর বিদ্যুতের যে পরিকল্পনা করেছে, তা অবশ্যই ইতিবাচক, তবে আগে দেখা গেছে অনেক কোম্পানি দরপত্রে জয়ী হলেও আর্থিক সক্ষমতা বা জমি না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ডাকা দরপত্রে প্রতিটি প্রস্তাব নিবিড়ভাবে যাচাই করতে হবে এবং আর্থিক সক্ষমতা ও নিজস্ব জমির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে শর্তাবলি তাদের জন্য সহায়ক হতে হবে।