রবিবার, ১২:০৮ অপরাহ্ন, ২০ জুলাই ২০২৫, ৫ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

অনুশোচনাহীন আওয়ামী লীগ: গোপালগঞ্জের ঘটনা কি নতুন কৌশলের অংশ?

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫
  • ৪ বার পঠিত

গোপালগঞ্জে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ঘিরে সংঘটিত সহিংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। এই ঘটনাকে ফ্যাসিবাদী  আওয়ামী লীগের একটি ‘ফাঁদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে রাজনৈতিক মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। অন্যদিকে বিভিন্ন মহল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা এবং সরকারের প্রস্তুতির দুর্বলতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

আবার কেউ কেউ বলছেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ নতুন করে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছে এবং এই উদ্দেশ্যেই তারা ফাঁদ পেতেছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই ঘটনাকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পেছানোর একটি নীলনকশা হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, গোপালগঞ্জের ঘটনা ছিল আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের অংশ এবং এখানে ‘পতিত ফ্যাসিস্টের দোসরদের কারসাজি’ পরিষ্কার।

হামলার প্লট তৈরি: গোপালগঞ্জে এনসিপির পূর্ব ঘোষিত জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির কয়েকদিন আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা উসকানিমূলক প্রচারণা শুরু হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধুর সমাধি ভেঙে ফেলা হতে পারে এমন প্রচারণা রীতিমতো আগুনে ঘি ঢালে। অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এরই জের ধরে তলে তলে এনসিপি নেতাকর্মীদের প্রতিহতের ঘোষণাও দেওয়া হয়। দুর্বৃত্তরা রাতারাতি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ওঠে। অথচ এর বিপরীতে সরকারে প্রস্তুতি ছিল দুর্বল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও তেমন সক্রিয়ভাবে মাঠে দেখা যায়নি। ঘটনার পর খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতির কথা স্বীকার করে নেন। তার দাবি-প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শত শত লোক শহরে জড়ো করা হয়। তারা সরাসরি হামলায় অংশ নেয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর ঠিক এই সময়ে ছাত্রজনতার ওপর নৃশংস কায়দায় দমন অভিযান চালায় পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু চলতি জুলাইয়ের চিত্র ভিন্ন। এই মুহূর্তে সেই বর্বরতা প্রচারের বদলে মূল ধারার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে চর্চা হচ্ছে গোপালগঞ্জের সংঘর্ষ। এ ঘটনায় হতাহতদের ভিকটিম সাজিয়ে ফায়দা হাসিলের তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে। এমনকি জুলাই নৃশংসতার অনেক ভিডিও গোপালগঞ্জ সংঘর্ষ দমনের ভিডিও বলেও চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানে চালানো পৈশাচিক বর্বরতা আড়াল করতেই পতিত স্বৈরাচার নতুন কৌশলে মাঠে নেমেছে। অনলাইন প্লাটফরমে ক্রমেই সোচ্চার হয়ে উঠছে পলাতক ফ্যাসিস্টের দোসররা। এমনকি আত্মগোপনে থাকা সাবেক মন্ত্রী-এমপিরাও সম্প্রতি গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। তাদের কেউ কেউ ঘটনার মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে এক ধরনের সহানুভূতি পেতে চাইছেন।

অনুশোচনা নেই: জুলাই গণহত্যা নিয়ে পতিত স্বৈরাচারের এখন পর্যন্ত কোনো অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে না। এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানকে বিদেশি ষড়যন্ত্র বলতেও দ্বিধা করছে না তারা। ভারতে পলাতক অবস্থায় শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন এটি কোনো অভ্যুত্থান নয়। তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতে ইউনূসের মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ। তবে শুধু হাসিনা একা নন তার দলের পলাতক অনেক নেতাও কথা বলছেন একই সুরে। গোপালগঞ্জের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ড. দিলারা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, জুলাই গণহত্যা নিয়ে এখনও আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ লাগিয়ে দিয়েছে। প্রশাসনে তাদের লোকজন এখনও বসে আছে। সরকার তাদের গায়ে হাত দিচ্ছে না।

এনসিপির মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এনসিপি তো অনুমোদন নিয়েই গিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন তো বলেনি আপনারা আসবেন না। আর আওয়ামী লীগ যদি কোনো ফাঁদ পেতে থাকে, তাহলে তো এনসিপি এর জন্য দায়ী নয়। দোষ প্রশাসনের।

এদিকে গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের পরপরই বুধবার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতে সংবাদ সম্মেলন ডাকে বিএনপি। এতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, উদ্ভূত ঘটনা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার এক গভীর নীলনকশা। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে কর্মসূচি নির্ধারণের আহ্বান জানান। এছাড়া সংঘর্ষ বিস্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততাকেও দায়ী করে বক্তব্য দেন বিএনপির এক শীর্ষ নেতা।

তবে ঘটনার পরদিন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, তার দল কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না। প্রশাসন এবং গোয়েন্দা সংস্থা যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিত তাহলে এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এর দায়ভার সরকার ও প্রশাসনকে নিতে হবে। এছাড়া দলের মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনায় এনসিপি ভিকটিম। এখন উলটো তাদের ওপর চাপিয়ে ভিকটিম ব্লেমিং করা হচ্ছে।

অনলাইন প্ল্যাটফরমে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন পদযাত্রার মধ্যে হঠাৎ কেন মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো? এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এনসিপির মুখপাত্র আরিফুল ইসলাম আদীব শনিবার যুগান্তরকে বলেন, পহেলা জুলাই দেশজুড়ে পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণার পর জনতার ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু গোপালগঞ্জ যাত্রার আগে আমরা নানা ধরনের হুমকি পাচ্ছিলাম। এ কারণে কর্মসূচিতে একটু বাড়তি মনোযোগ দিতেই মার্চ টু গোপালগঞ্জ ঘোষণা করা হয়। তবে প্রাণনাশের হুমকির মধ্যেই এনসিপি পিছু হটেনি। গোপালগঞ্জে সফলভাবে কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ : গোপালগঞ্জের ঘটনায় রাজনৈতিক নেতাদের কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছেন। তারা বলছেন, এ ঘটনায় ফ্যাসিস্টের দোসর হিসাবে পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ নেপথ্যের কুশীলব হিসাবে ভূমিকা রেখেছেন। টেলিভিশন ক্যামেরায় স্পষ্ট দেখা যায় হামলা প্রতিহতের চেষ্টা না করে বরং পুলিশ সদ্যদের কেউ কেউ পেছনের দরজা বেছে নেন। তাদের একটি বড় অংশ ছিলেন দর্শকের সারিতে। সেখানকার পুলিশ সুপারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি এটা আগেই বলেছি। পুলিশের একটা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ছিল। তবে এ জন্য পরিস্থিতিই দায়ী। কারণ জুলাই অভ্যুত্থানের পর তো পুলিশ পালিয়ে গিয়েছিল। এখনও তারা সাহস খুঁজে পায়নি। ফলে পুলিশ এখন আর সেভাবে সক্রিয় হয় না।’

অবশ্য পুলিশের দাবি হামলা ঠেকাতে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ঘটনার সময় পর্যাপ্ত টিয়ারশেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। শুধু শহরেই চার শতাধিক পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল। তবে গোয়েন্দা তথ্য অপর্যাপ্ত ছিল। দুর্বৃত্তদের চোরাগোপ্তা হামলায় সাময়িকভাবে পুলিশ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। এছাড়া সেনাবাহিনীর সহায়তায় এনসিপির নেতাকর্মীদের অক্ষত অবস্থায় সেখান থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক শুক্রবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার পর থেকে তিনি নিজে গোপালগঞ্জে অবস্থান করে ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। ইতোমধ্যে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ঘটনার দায়দায়িত্ব নিরূপণ করা হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com