সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এক বিশেষ মুহূর্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াইয়ে থাকা দলটি অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে গত সপ্তাহে পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যা নিয়ে ‘অপপ্রচার’-এর বিরুদ্ধে একযোগে সোচ্চার হয়েছে বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনগুলো। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বিচ্ছিন্ন ঘটনায় তাদের নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ‘অপপ্রচার’ চালানো হচ্ছে। এ ঘটনায় রাজনীতির নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। এমন প্রেক্ষাপটে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে গত সোমবার রাজপথে নতুনভাবে দলের কঠোর অবস্থান জানান দিয়েছেন তারা। সেদিন ঢাকাসহ সারা দেশে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি ও বিশাল জমায়েত আয়োজন করে দলের পক্ষ থেকে এ অবস্থান তুলে ধরা হয়। কর্মসূচির মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীরা তাদের সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলায় গুরুত্ব দেন। আগামী দিনে এমন প্রতিবাদ ও জনস্বার্থে কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে তারা। দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, জনগণই তাদের আসল শক্তি। সেজন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সংকট কাটাতে চান।
এদিকে, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা ও সাংগঠনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিশৃঙ্খল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এবার হার্ডলাইনে বিএনপির হাইকমান্ড। মূলত ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংগঠনের কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য ও প্রভাব বিস্তারের নামে অপতৎপরতার অভিযোগ ওঠায় দলটির হাইকমান্ড কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে বিএনপির অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বিএনপির পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি হস্তক্ষেপে বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে। অতীতে দলের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে চলা নানামুখী বিশৃঙ্খলা ও জনবিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা থাকলেও এবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন—‘দল দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়স্থল হতে পারে না। চাঁদাবাজ ও উচ্ছৃঙ্খল নেতাদের কোনো ছাড় নেই। প্রয়োজনে প্রকাশ্যে বহিষ্কার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হবে।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে যেসব নেতাকর্মী অবৈধ দখল, চাঁদাবাজি ও বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, এরই মধ্যে চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখল এবং বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে লিপ্ত এমন শতাধিক বিশৃঙ্খল নেতাকর্মীর নামের তালিকা তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই তালিকায় বিএনপির একাধিক প্রভাবশালী নেতা এবং কয়েকটি অঙ্গসহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতার নামও রয়েছে। এই পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে। অবশ্য অভিযুক্তরা টের পেয়ে নিজেদের পদ রক্ষার জন্য লন্ডনকেন্দ্রিক যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। যদিও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারেক রহমান। প্রয়োজনে দু-একটি অঙ্গসংগঠনের কমিটি ভেঙে দেওয়ার চিন্তা করছেন তিনি। তা ছাড়া বিশৃঙ্খল ও দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীদের সতর্ক করে সংশ্লিষ্ট নেতারা ফেসবুকে সতর্কতামূলক পোস্ট করছেন। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে অসংখ্য নেতাকর্মীকে শোকজ করা হয়েছে। বহিষ্কার করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড।
বিএনপির নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে পরিকল্পিতভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। কেননা, তিনি যখন স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখনই পরাজিত শক্তির দোসর ও সুযোগসন্ধানী কুচক্রীরা তারেক রহমানের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কুৎসা রটাচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীরা চাচ্ছে না দেশে এসে পিতার মতো শক্তভাবে দলের হাল ধরুক তারেক রহমান। পরিকল্পিতভাবে টার্গেট বানিয়ে সামাজিকমাধ্যমেও তার বিরুদ্ধে রীতিমতো নোংরা ক্যাম্পেইন চলছে। তার নেতৃত্ব ধ্বংস করাই যেন এর মূল টার্গেট।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন গতকাল কালবেলাকে বলেন, এ কথা তো পরিষ্কার যে, বিএনপির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার চলছে। বিএনপিও এসব অপপ্রচার রাজনৈতিকভাবে অতিক্রম করবে। কারণ, মিথ্যা তথ্য দিয়ে সত্যকে ঢেকে ফেলা যায় না। বিএনপি একটি বিরাট ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। সব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ ও প্রতিকার করব ইনশাআল্লাহ। শোকজ ও বহিষ্কারের মতো কঠোর শাস্তির পরও কিছু বিশৃঙ্খল নেতাকর্মী বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক জাহিদ বলেন, বিএনপি তো প্রতিনিয়ত সাংগঠনিকভাবে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। সতর্কতার পরও এ কথা তো কেউ হলফ করে বলতে পারবে না যে, দুর্ঘটনা ঘটবে না। সুতরাং অন্যায়কারী যে-ই হোন না কেন, তার কোনো দলীয় পরিচয় নেই। তাকে আইনের আওতায় আনাটা শ্রেয়। মানুষ যখন দেখবে যে, অন্যায়কারী শাস্তি পাচ্ছে, আইনের শাসনের প্রয়োগ হচ্ছে, তখন কিন্তু মানুষ সচেতন হবে এবং অন্যায় কমবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পেশাদারিত্ব বজায় রেখে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুতগতিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই অন্যায়-অবিচার কমবে, অন্যথায় নয়।
সাংগঠনিক সূত্র জানায়, শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপি এরই মধ্যে ৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার ও শোকজ করেছে। এর মধ্যে বহিষ্কারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। ২ হাজারের মতো নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানো ও সতর্ক করা হয়েছে। এ ছাড়া এসব ঘটনায় ছাত্রদল এখন পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় সাড়ে তিনশজনকে বহিষ্কার ও সাড়ে পাঁচশ নেতাকর্মীকে শোকজ করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের কমপক্ষে শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার, দেড় শতাধিক নেতাকে শোকজ ও কমপক্ষে শতাধিক নেতাকর্মীর পদ স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া যুবদলের ১৫০ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ৫৬ জনকে শোকজ এবং পাঁচজনের পদ স্থগিত করা হয়েছে। সর্বশেষ ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন সংগঠনের পাঁচজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। বহিষ্কৃতরা হলেন যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-জলবায়ুবিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকি, স্বেচ্ছাসেবক দলের কালু এবং চকবাজার থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব অপু দাস ও মাহমুদুল হাসান মাহিন।
বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, যাদের বিরুদ্ধে অপকর্মে জড়িত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তারা যত বড় প্রভাবশালী নেতা হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বেশকিছু জায়গায় অপকর্মে জড়িত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষ থেকেই মামলা করা হয়েছে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ কেউ দাবি করেন, বাস্তবে ঘটনার চেয়ে দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বেশি হচ্ছে, যা একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে করছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, রাষ্ট্রের ভেতর ও বাইরে থেকে গভীর চক্রান্ত চলছে এবং টার্গেট করা হয়েছে তারেক রহমানকে। জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করার লক্ষ্যেই এসব চক্রান্ত হচ্ছে। তারেক রহমানকে নিশানা করার কারণ হলো, তিনি ১০ হাজার মাইল দূরে থেকেও দেশের গ্রামাঞ্চল থেকে শহর এবং শহরাঞ্চল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত মানুষকে সংগঠিত করেছেন। এজন্যই কয়েকটি রাজনৈতিক দলের যত প্রতিহিংসা। তারেক রহমান কোনো অপরাধীকে প্রশ্রয় দেননি, এখন পর্যন্ত ৫ থেকে ৬ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছেন। বিএনপি বৃহৎ পরিবার, বিভিন্ন জায়গায় অনেকে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অপকর্মের চেষ্টা করছে, তবে এসব জানার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারেক রহমান। দলের নামে যে কেউ কোনোরকম অনৈতিক, অবৈধ, সন্ত্রাসী ও সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড করবে, সে রেহাই পাবে না। একই সঙ্গে কোনো উসকানির মুখে প্রতিক্রিয়া না দেখাতে নেতাকর্মীদের প্রতি তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।
আলাপকালে বিএনপি নেতারা জানান, বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী স্বৈরাচার সরকারের আমলে যারা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সখ্য রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন, সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর তারাই হঠাৎ বড় বিএনপি বনে গেছেন। দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সর্বত্রই এখন তাদের উৎপাত। এসব ‘হাইব্রিড’ তথ্য ‘নব্য বিএনপি’র দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে লড়াই-সংগ্রামে থাকা ত্যাগী নেতাকর্মীরা। শুধু বিএনপি নাম ধারণই নয়, দখল, টেন্ডার, চাঁদাবাজিসহ জড়িয়ে পড়েছেন নানা অপকর্মে। যার দায় বহন করতে হচ্ছে বিএনপিকে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব হাইব্রিড লোকজনকে বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, তারেক ও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কঠোরতা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অভিযোগ উঠছে বিএনপির বেশকিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত তদন্ত করে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য মতে, আধিপত্য বিস্তার, নেতৃত্বের রেষারেষি ও বিরোধ, মূল সংগঠনের সঙ্গে অঙ্গসংগঠনের মতভিন্নতা, স্বার্থের দ্বন্দ্বে গত বছরের ৭ আগস্ট থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ১১ মাসে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ৪৭৮টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৮০ জনের বেশি নেতাকর্মী নিহত ও কয়েক হাজার আহত হয়েছেন। অন্যদিকে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত ১০ মাসে ৬৮ নেতাকর্মী খুন হয়েছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির বিশেষ সহকারী বদরুল আলম চৌধুরী শিপুল কালবেলাকে বলেন, একটি চিহ্নিত পক্ষ তারেক রহমানকে নিয়ে অশ্লীল কটূক্তি ও ষড়যন্ত্র করছে। মূলত তারেক রহমানের জনপ্রিয়তায় ভয় পেয়ে ও নির্বাচন ঠেকাতে চক্রান্তকারীরা পরিকল্পিতভাবে এসব করছে। তবে একটি কথা পরিষ্কার, গত ১৬টি বছর আমরা বহুভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছি। কিন্তু জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ফ্যাসিবাদী শক্তির পতন ঘটিয়েছে। আগামীতেও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অপশক্তির পতন ঘটানো হবে।