ভাঙাড়ি ব্যবসার আধিপত্য ও স্থানীয় একটি দোকানে কারা ব্যবসা করবে- এ নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারই পূর্বপরিচিতরা। নিহত এবং হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা একসময় যৌথভাবে ব্যবসাও করতেন। তবে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে এখনও চাঁদাবাজির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করেন ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার(ডিসি) মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পুুরান ঢাকায় তামার তার ও সাদা তারের অবৈধ ব্যবসার আধিপত্য ধরে রাখায় কাল হয়েছে ব্যবসায়ী সোহাগের।
অন্যদিকে নিহতের স্বজনরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডে রাজনীতির কোনো বিষয় না থাকলেও দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দেওয়ায় এবং ব্যবসাকেন্দ্র দখলে বাধা পেয়ে সোহাগকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে স্থানীয় যুবদলের কিছু নেতাকর্মী। খুনিদের দ্রুত বিচার চান তারা।
এদিকে ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যার ঘটনায় মো. টিটন গাজী নামে এজাহারনামীয় আরও এক আসামিকে গত শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। তাদের মধ্যে লম্বা মনির ও আলমগীরকে র?্যাব এবং মাহমুদুল হাসান মহিন, তারেক রহমান রবিন ও টিটন গাজীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরও পাঁচজনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছেন বলে সূত্র জানালেও তদন্তসংশ্লিষ্ট কেউ তা নিশ্চিত করেননি।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল আসামি মো. টিটন গাজীর পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিব উল্লাহ গিয়াস শুনানি শেষে এই আদেশ দেন। একই ঘটনার অস্ত্র আইনে মামলায় আসামি তারেক রহমান রবিন আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
গতকাল দুপুরে কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) একেএম শহিদুর রহমান বলেন, সোহাগ হত্যার ঘটনায় গত শুক্রবার রাজধানীর কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে এজাহানামীয় ৪ নম্বর আসামি আলমগীর ও ৫ নম্বর আসামি মনির ওরফে লম্বা মনিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বলেন, ঘটনার মূল তদন্ত করছে ডিএমপি। র্যাব ছায়া তদন্তের মাধ্যমে ডিএমপিকে সহায়তা করছে। প্রাথমিক তদন্তে এখনও কী কারণে ঘটনাটি ঘটেছে, এটা বিস্তারিত বলার মতো পর্যায়ে আমরা নেই।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগে পলাশ নামে এক ভাঙাড়ি ব্যবসায়ীর অধীনে কাজ করতেন সোহাগ। ভাঙাড়ি পণ্য এনে পলাশের কাছে বিক্রি করতেন। প্রায় পাঁচ বছর আগে তিনি তামার তার কেনাবেচার আলাদা ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায়িক বিভিন্ন বিষয়সহ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একটি পক্ষের (হত্যাকারী) সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়। এর জের ধরে তারা সোহাগের গুদাম কিছুদিন তালাবদ্ধও করে রেখেছিল। সম্প্রতি ব্যবসার অর্ধেক ভাগ দাবি করেন স্থানীয় যুবদল নেতা গ্রেপ্তার হওয়া মহিন। তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সোহাগকে প্রায়ই হুমকি-ধমকি দেওয়া হতো। আতঙ্ক ছড়াতে হত্যার আগের দিনও তার গুদামে গুলি চালায়। গত বুধবার মীমাংসা করার কথা বলে দোকান থেকে ডেকে নিয়ে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা মিটফোর্ড হাসপাতালের তিন নম্বর ফটকের সামনে সোহাগকে নির্মমভাবে কুপিয়ে, পিটিয়ে ও পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিহত সোহাগ ও হামলায় জড়িতরা ৩০ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। হত্যায় অংশগ্রহণকারীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মহানগর যুবদলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছাড়াও কয়েকজন নেতার নাম এসেছে। সব বিষয়কেই সামনে রেখে তদন্ত কার্যক্রম চলছে। তদন্তে মামলা নিতে থানা পুলিশের গড়িমসি এবং ঘটনায় জড়িত কয়েকজনের নাম বাদ দিয়ে অন্য কাউকে আসামি করার অভিযোগের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জানা গেছে, একসময় যুবদলের সদস্য নিহত সোহাগ ও চকবাজার থানা যুবদলের সদস্য সচিব পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান মহিন একসঙ্গে চলাফেরা করলেও এলাকায় বিদ্যুতের তামার তার ও সাদা তারের অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। তামার তার ও সাদা তারের ব্যবসার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল সোহাগের কাছে। সেটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল মহিন, অপু, চকবাজার থানা যুবদলের সাবেক সদস্য সারোয়ার হোসেন টিটু, যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ুবিষয়ক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টুসহ মিটফোর্ড হাসপাতালের একটি চক্র। তারা ওই অবৈধ বাণিজ্যের ৫০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ চায়।
জানা গেছে, এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেয় মহিন এবং চকবাজার থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব অপু দাস। হামলায় অংশ নেওয়া মহিনের অনুসারী রিয়াদ, সজীব, নান্নু (মিটফোর্ড হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার), লম্বা মনির ও ছোট মনির (মিটফোর্ড হাসপাতালের আউটসোর্সিং কর্মচারী) সোহাগের মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে। সোহাগের লাশে সর্বশেষ সিমেন্টের ব্লক দিয়ে আঘাত করে যুবদল নেতা রজ্জব আলী।
ডিএমপির লালবাগ বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, সোহাগ এবং খুনিরা একসঙ্গে কিছুদিন ব্যবসাও করে। ভাঙাড়ি ব্যবসা এবং দোকানে কারা ব্যবসা করবে সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। ব্যবসার লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে তারা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। তিনি বলেন, অপরাধ তদন্তে খুনিদের রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য নয়। এখনও চাঁদাবাজির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দোষীদের দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছে নিহতের স্বজনরা। গতকাল আয়োজিত এক মানববন্ধন থেকে তারা এই দাবি তুলে ধরেন সোহাগের বড় বোন ফাতেমা। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তার ভাই সোহাগ ওই দোকান থেকেই জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। এই ব্যবসা নিয়েই হিংসা, প্রতিহিংসা সবকিছু। খুনিরা তার দোকান দখল করতে চেয়েছিল। এ সময় নিহতের স্ত্রী লাকি বেগম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমার স্বামীর দোকান থেকে চাঁদা দাবি করে আসছিল কয়েকজন। আমার স্বামী রাজি হননি। তিনি বলেন, আমি এ নরপশুদের বিচার চাই।
অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত করার দাবি বিএনপি মহাসচিবের : সোহাগ হত্যাকাণ্ডসহ কয়েকটি ঘটনার অতি দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করার জন্য দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল বিকালে গুলশানে হোটেল লেকশোরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে তিনি এ দাবি জানান।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই, যে ঘটনাগুলো ঘটছে সরকারকে আহ্বান জানাব, অতি দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত যারা অপরাধী তাদের বের করে শান্তির ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় জাতি আপনাদের ক্ষমা করবে না। তিনি ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, আর কিছুদিন ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করুন গণতন্ত্রের জন্য এবং সবাইকে বিরত রাখুন কেউ যেন অন্যায় কাজ করতে না পারে।