রাজনৈতিক ডামাডোল আর উত্তেজনার মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে আগামীকাল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি হতে যাচ্ছে সর্বপ্রথম ছাত্র নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল। নতুন এই দল ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে কৌতূহল। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। নতুন এই দল গঠনের বিষয়টিকে অনেক রাজনৈতিক দল সাধুবাদ জানালেও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে নতুন দল গঠিত হচ্ছে বলে সমালোচনাও আছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর আলোচনায় উঠে আসে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে নতুন দল গঠনের কথা। কয়েক মাস ধরেই বিষয়টি আলোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, নতুন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেবেন নাহিদ ইসলাম—এটি এখন চূড়ান্ত। সে কারণে তিনি উপদেষ্টার পদ থেকে ইতোমধ্যে পদত্যাগও করেছেন। সদস্য সচিব হিসেবে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনই থাকছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পাশাপাশি নতুন দলের শীর্ষ ৬ পদে কারা থাকছেন তাও মোটামুটি নিশ্চিত বলা যায়।
নতুন এই রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের দুদিন আগে গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করে নতুন ছাত্র সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’। গতকাল বুধবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এই সংগঠনের নাম ও কমিটি ঘোষণা করা হয়। নতুন এই ছাত্র সংগঠনের আহ্বায়ক হয়েছেন আবু বাকের মজুমদার। আর সদস্য সচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন জাহিদ আহসান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকে বলা হয়েছে, তাদের নতুন রাজনৈতিক দলটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী জনপ্রত্যাশা পূরণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, যার গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনী ইশতেহারেও থাকবে বৈচিত্র্য। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে এই দল। প্রয়োজনে তারা নির্বাচনী জোটও করতে পারে।
রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে ইতোমধ্যে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষিত হয়েছে। ঠিক এ মুহূর্তে আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া নতুন দলে কারা থাকবেন, দলের নীতি-আদর্শ কী হবে, সম্ভাব্য শীর্ষ নেতাই বা কে হবেন, সেসবের দিকে এখন দৃষ্টি সবার। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং পেশাজীবী সংগঠনের মানুষেরও দৃষ্টি এই দলের দিকে। যদিও বাংলাদেশের বাস্তবতায় গত প্রায় চার দশকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো সারা দেশে বিস্তৃত বড় কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি হয়নি। বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও সেগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দলে রূপান্তরিত হতে পারেনি। এ ছাড়া বাম-ডান, জাতীয়তাবাদী থেকে শুরু করে ইসলামপন্থি আদর্শের রাজনীতিও আগে থেকেই উপস্থিত আছে দেশটিতে। ফলে ছাত্রদের নতুন দল নিয়ে এখন সর্বত্র চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, নতুন দল গঠনকে বিএনপি ভয় পাচ্ছে না। এ নিয়ে কোনো ভয়, আশঙ্কা বা উদ্বেগ তাদের মধ্যে কাজ করছে না। যে কেউ নতুন দল করতে পারে। আপত্তি নেই; কিন্তু বর্তমান সরকার নিজেরা নিজেদের নির্দলীয় ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে। এখন এ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন হলে সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে। যেটা দেশ ও জনগণের জন্য ভালো হবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেছে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার তারা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেবে। ফলে নির্বাচনে যাতে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু ক্ষমতায় থেকে কেউ যদি নির্বাচন করে তাহলে সেই নির্বাচন যে নিরপেক্ষ হয় না সেটা তো শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন বারবার।
এর আগে নতুন দল সম্পর্কে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেন, বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করলে সরকার থেকে বেরিয়ে এসে সেটা করা উচিত। ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতেই পারে। এটা তো তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সেক্ষেত্রে আমরা তাদের স্বাগত জানাব; কিন্তু একটা কথা ইতোমধ্যে মিডিয়ায় কিংস পার্টি বলে একটা কথা উঠছে। আমি মনে করি এখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসা উচিত। অর্থাৎ সরকারের কোনো সাহায্য না নিয়ে তারা যদি দল গঠন করতে চায়, সেটা তাদের জন্যই ভালো হবে।
ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, রাজনৈতিক দল করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। ছাত্ররা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে তারা নতুন দল গঠন করবে। তার মানে তাদের চিন্তা ও কর্মের মধ্যে নতুন দল গঠনের বিষয়টি আছে। আমরা তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি নিরপেক্ষ সরকারে থেকে দল গঠনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা ছাত্রদের কাছ থেকে মানুষ প্রত্যাশা করে না।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির বিশেষ সহকারী বদরুল আলম চৌধুরী শিপলু বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে কেউ দল করতে পারে। সেটি যেন সরকারের ছত্রছায়ায় না হয়। আমরা নতুন দলকে স্বাগত জানাব এবং আশা করি যে রাজনৈতিক দল গঠিত হবে তারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর অটল থাকবে। নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতি প্রত্যাশা থাকবে, তারা যাতে ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক চেতনা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর অপতৎপরতা এবং গোপন তৎপরতার রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, কেউ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাইলে আমরা অবশ্যই তাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু ক্ষমতার ছত্রছায়ায় কিংবা ক্ষমতার প্রভাব বলয়ে থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা হলে জনগণ তা ভালো চোখে দেখবে না। কেউ নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাইলে ক্ষমতার বাইরে থেকে জনগণের মধ্য থেকে করা উচিত।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) চেয়ারম্যান ক্বারি আবু তাহের নতুন দলকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সমন্বয়ে নতুন দল বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং গণতন্ত্রের জন্য কাজ করবে। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও বৈষম্যের ঠাঁই যাতে বাংলাদেশে না হয়।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখছে, তরুণরা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসনের প্রতিভূ শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। যে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার পর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের মনে সেরকম নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। রক্তের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা সামনে নিয়ে এ দলটি কাজ করবে।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত নাম চূড়ান্ত না হলেও ‘জনতার দল’, ‘নতুন বাংলাদেশ পার্টি’, ‘বিপ্লবী দল’, ‘নাগরিক শক্তি’, ‘বাংলাদেশ বিপ্লবী পার্টি’, ‘রিপাবলিক পার্টি’, ‘বাংলাদেশ সিটিজেনস পার্টি’সহ কয়েকটি নাম আলোচনায় রয়েছে।
নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা জানান, আগামীকাল শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বড় জমায়েতের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম ঘোষণা করা হবে। দুই লাখ মানুষের জমায়েতের মাধ্যমে দল ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।