ভরা মৌসুমে সারা দেশের মতো চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে চা শিল্প। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও গুণগত মান নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। যার প্রভাব পড়বে আগামী রফতানি বাজারে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে লোডশেডিং শিডিউল চালু হওয়ায় এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের অন্যতম অর্থকরী ও রফতানিযোগ্য ফসল চা।
শ্রীমঙ্গলসহ মৌলভীবাজার জেলায় লোডশেডিং প্রতিদিন দুই থেকে চার-পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরো বেশি। যার ফলে চলতি বছরে ১০ হাজার কোটি কেজি চায়ের যে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
সারা দেশে মোট ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে শুধু মৌলভীবাজার জেলাতেই রয়েছে ৯২টি চা বাগান। এখানকার চায়ের গুণগত মান অন্য এলাকার চা থেকে অনেক ভালো এবং দেশের সিংহভাগ চা উৎপাদন হয় মৌলভীবাজার জেলায়। যে কারণে শ্রীমঙ্গলকে বলা হয় চায়ের রাজধানী। দেশের অভ্যন্তরীণ চায়ের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এ অঞ্চলের চা রফতানি করা হয়। তবে হঠাৎ করে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ায় চা শিল্প এখন নানামুখী সঙ্কটে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
চা শিল্পের সাথে জড়িতরা বলছেন, হঠাৎ করে লোডশেডিংয়ের মাত্রা তীব্র হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া। জুলাই থেকে অক্টোবর মাসকে বলা হয় চা উৎপাদন মৌসুম। এ সময়ে প্রতিটি বাগানের ফ্যাক্টরিতে ক্ষেত্রভেদে পাঁচ থেকে ৭০ হাজার কেজি চা পাতা আসে প্রক্রিয়াজাতের জন্য। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে এই কাঁচাপাতা প্রক্রিয়াজাত করতে সমস্যায় পড়ছেন বাগান মালিকরা। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় চা বাগানের কারখানাগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু রাখা যাচ্ছে না। এতে করে নষ্ট হচ্ছে চায়ের গুণগত মান। যার প্রভাব পড়বে রফতানি বাজারেও। চায়ের মান খারাপ হলে চা পাতা রফতানি করা যাবে না। আবার রফতানি করা হলেও সেটি ফেরত আসার আশঙ্কা থাকবে। তখন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চায়ের মর্যাদাহানি ঘটবে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানান।
অন্যদিকে জেনারেটর চালিয়ে চায়ের কারখানাগুলোকে সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ এতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে অনেক। আবার চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি তেল না পাওয়ার কথাও বলছেন তারা। এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেকে সহসা উত্তরণের কোনো আশাও দেখাতে পারছে না মৌলভীবাজারের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। সব মিলিয়ে একধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে চা বাগানগুলোর মালিক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চলতি চা মৌসুমে দেশে মোট চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০০ বিলিয়ন কেজি। কিন্তু লোডশেডিং ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
ন্যাশনাল টি কোম্পানির কুরমা চা বাগানের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আক্তার শহীদ বলেন, চা উৎপাদনের খুব ক্ষতি হচ্ছে, আমি একটানা দুই ঘণ্টা ফ্যাক্টরি চালাতে পারছি না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ থাকছে। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে পরের দুই ঘণ্টা থাকছে না। একটানা যদি ফ্যাক্টরি না চলে তাহলে চায়ের গুণগত মান নষ্ট হয়।’
শাহবাজপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে, আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ যখন চলে যায় তখন আমাদের জেনারেটর চালাতে হয় আর জেনারেটর চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় ডিজেলের। ডিজেলপ্রতি লিটার ৮৫ টাকা, কিন্তু সেই ডিজেলও আমরা চাহিদামতো পাচ্ছি না। তারপর সরকার আবার বলেছে, পেট্রোল পাম্প সপ্তাহে একদিন বন্ধ থাকবে। যে কারণে জেনারেটার চালিয়েও উৎপাদন ঠিক রাখা যাচ্ছে না।
ইস্পাহানি জেরিন চা বাগানের ব্যবস্থাপক সেলিম রেজা বলেন, আমরা প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে চার হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা প্রক্রিয়াজাত করি। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় আমরা গ্যাসচালিত জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রেখেছি। এতে আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন সিলেট শাখার চেয়ারম্যান জিএম শিবলী বলেন, বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে আমাদের সবগুলো বাগানেই চা উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। চা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সব যন্ত্রপাতি জেনারেটর দিয়ে চালানো সম্ভব হয় না। তা ছাড়া সব কিছুর দাম বাড়লেও চায়ের দাম কিন্তু সেভাবে বাড়েনি। এখন এ সমস্যার জন্য গুণগত মান যদি কমে যায়, তাহলে চায়ের দামও কমে যাবে।
বিদেশে চা রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের বিপণন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজালাল বলেন, চায়ের গুণগত মান খারাপ হলে রফতানি বাজারে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। খারাপ মানের কোনো চা বিশ্ববাজারে বিক্রি করা সম্ভব না। আর বিক্রি করলেও সেটি ফেরত আসবে। ফলে দেশের চায়ের রফতানি বাজার ও চা শিল্প দুটোই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একটি বা দুটি চা কারখানা হলে আমরা তাদের আলাদা গুরুত্ব দিতে পারতাম। কিন্তু এখানে একাধিক চা কারখানা হওয়ায় আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে যদি পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়, তাহলে এটার একটা সুরাহা হবে। বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা পিক আওয়ারে ৯০ মেগাওয়াট আর সরবরাহ ৬০ মেগাওয়াট। অফপিক আওয়ারে চাহিদা ৫৫ মেগাওয়াট এবং সরবরাহ হচ্ছে ৪০ মেগাওয়াট।