এরশাদের বিরুদ্ধে এর আগে টানা ৯ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দল বেঈমানি করে ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে সেই আন্দোলন থিতিয়ে পড়ে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আরেক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের পথ ধরে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ইতিহাসের খাতায় এই দুটি সংগঠন জাতীয় বেঈমান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। অপরপক্ষে সেই নির্বাচন বর্জন করার মধ্য দিয়ে এবং এরশাদ পতন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না কিংবা হতে দেওয়া হবে না এমন ঘোষণা দিয়ে আপসহীন নেতৃত্বের খেতাব অর্জন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একদিকে আমান-খোকনের নেতৃত্বে সংগ্রামী ছাত্র ঐক্যজোট ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ লিয়াজোঁ করে রাজপথে সোচ্চার ছিল। আর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাতদলীয় জোট কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। এরই মধ্যে শেখ হাসিনার বেঈমানির কারণে তাঁরই ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব নিজ দল ত্যাগ করে আমানউল্লাহ আমানের সঙ্গে যোগদান করেন। গোটা রাজপথ তখন দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। পতন ঘটে স্বৈরশাসকের ৯ বছরের দুঃশাসন। এ কথা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট যে সেদিন ডাকসুতে আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকনের নেতৃত্বে ছাত্রদল বিজয়ী না হলে এমন আন্দোলন গড়ে তোলা কষ্টসাধ্য ছিল।
এরপর দীর্ঘদিন ডাকসুর নির্বাচন হয়নি। ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন ঘোষণা করা হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নুরুল হক নুর ও ছাত্রলীগের গোলাম রব্বানী যথাক্রমে ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়েই ডাকসুর পুরো প্যানেল গণভবনে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কদমবুসি করে আসে। এরপর শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রথম শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা বিলুপ্ত করেন। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন প্রতিনিধি হাইকোর্টে রিট করলে কোটাপ্রথা আবার ফিরে আসে। সেই কোটা সংস্কার করার জন্য জুলাই থেকে শুরু হয় আন্দোলন, যেখানে আন্দোলনরত সব পক্ষ এক হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। প্রায় দেড় হাজার জীবনের বিনিময়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রাণভয়ে গণভবন ছেড়ে পালিয়ে ভারতের দিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন। গোটা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যাঁরা পালন করেছেন নেপথ্যে থেকে, তাঁরা হলেন ছাত্রদলের সৈনিক। সেই আন্দোলনে ছাত্রদলের ১৪৪ জন শাহাদাত বরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান ও ছাত্রদল কবি জসীমউদ্দীন হল শাখার আহ্বায়ক তানভীর বারি হামিম এবার ডাকসুতে ছাত্রদলের প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছাত্রশিবিরের প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাদিক কায়েম ও এস এম ফরহাদ। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আব্দুল কাদের ও আবু বাকের মজুমদার। ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিন ইয়ামিন মোল্লা ও সাবিনা ইয়াসমিন। বাম ছাত্রজোট সমর্থিত পরিষদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি ও মেঘমল্লার বসু। উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উমামা ফাতেমা ও আল সাদী ভূঁইয়া।
যেসব ছাত্রনেতা এবারের ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁরা হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত ১৭ বছর ছাত্রদলকে কোনো অবস্থায়ই কোনো শিক্ষাঙ্গনে তাদের রাজনীতি করতে দেওয়া হয়নি। ছাত্রদল যতবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কিছু করার চেষ্টা করেছে, ততবারই তাদের ওপর হামলা করেছে ছাত্রলীগের হায়েনার দল। বিএনপির বর্তমান প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু সে সময়ে ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তিনি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে মারাত্মক জখম হন। এর পরও বহুবার ছাত্রদল হামলার শিকার হয়েছে, কিন্তু থেমে থাকেনি তাদের আন্দোলন-সংগ্রাম। ছাত্রদলই একমাত্র সংগঠন, যারা গত ১৭ বছর প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। অন্য অনেক সংগঠনের কর্মীরা গুপ্তভাবে ছাত্রলীগের মধ্যে মিশে গিয়ে তাঁদের লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের যে ছেলেটি আজ ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) পদে লড়াই করছেন, তিনি হলেন আবিদুল ইসলাম খান, যিনি জুলাই আন্দোলনের সময় সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি এরই মধ্যে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করেছেন। একইভাবে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী শেখ তানভীর বারি হামিম জুলাই বিপ্লবসহ শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রসেনানী। মিছিলে-স্লোগানে রাজপথ কাঁপানো হামিম এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা। আগামী দিনগুলোতে যতই বিপদাপদ আসুক না কেন, সত্য এবং ন্যায়ের পথে থেকে মোকাবেলা করার সাহস রাখেন এই অকুতোভয় সৈনিক। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল যথার্থই ডাকসুর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এমন দুজন নেতাকে কাছে পেয়েছে।
জাতীয় রাজনীতিতে একটি চক্র কেবল বিএনপিকে ঠেকানোর জন্য যেমন ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে, সেটি ডাকসু নির্বাচনেও চলতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। অতএব চোখ-কান খোলা রেখেই ছাত্রদলকে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক