নজিরবিহীন আর্থিক দৈন্যদশায় পতিত দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা সম্প্রতি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। দেশটিতে চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে কয়েক মাস ধরে আলোচনা চলছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। যার মধ্যে বাংলাদেশের মতো উদীয় অর্থনীতির দেশগুলো একই ধরনের সংকটে পড়তে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। গতকাল সোমবার থাইল্যান্ডের ব্যাংকক পোস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। জন রোজারিও নামে ভারতের এক বিশ্লেষকের লেখা ওই নিবন্ধে বাংলাদেশ এবং শ্রীলংকার অর্থনীতির তুলনামূলক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ব্লুমবার্গের তথ্যের ভিত্তিতে ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট সম্প্রতি ঋণ ঝুঁকিতে থাকা ২৫ দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে রাশিয়া, জাম্বিয়া, সারিনেম, লেবানন ও কয়েকটি দেশ তাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে পিছিয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বেলারুশ। এ ছাড়া আর্জেন্টিনা, ইউক্রেন, তিউনিসিয়া, ঘানা, মিসর, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, এল সালভাদর, পাকিস্তান, বেলারুশ ও ইকুয়েডর রয়েছে মূল্যস্ফীতি, ঋণ ও উচ্চ ঋণ ব্যয়ের তালিকায়। এই তালিকায় বাংলাদেশ নেই।
তবে এটি সত্যি যে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু দেশটির সরকার অর্থনীতির গতিকে সচল রাখতে এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সীমিত করা হয়েছে, ডলারের বিপরীতে কমানো হয়েছে টাকার মূল্যমান, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সে নগদ উপহার দেওয়া হচ্ছে, বিলাসবহুল পণ্যে করা হয়েছে করারোপ। এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে, যাতে আমদানি ব্যয় সহজে মেটানো যায়। এরই মধ্যে সরকার রপ্তানি বৃদ্ধি এবং আমদানি কমানোর নীতি নিয়েছে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যে আরও ব্যাপকতা পেয়েছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। যার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশকে অবশ্যই আমদানি-রপ্তানির অনুপাতের উন্নতির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সমান অগ্রাধিকার দিতে হবে। যদিও এখনো বাংলাদেশের ন্যূনতম তিন মাসের চেয়ে বেশি দিন আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা আরও দুর্বল হলে রিজার্ভ কমে যাওয়া উদ্বেগের কারণ হতে পারে। তাই অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ ও পুনরুদ্ধারে একটি ব্যাপক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাজেট ব্যবস্থাপনার সব স্তরে কৌশলগত হস্তক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মন্ত্রী ও বিভাগগুলোকে পরামর্শ দিচ্ছেন কীভাবে বিদেশ ভ্রমণের ব্যয় ছাড়াই উন্নয়ন প্রকল্প চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। অর্থনীতির ওপর চাপ কমাতে তিনি শুধু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো স্থগিতে গুরুত্বারোপ করেছেন।
এরপরও কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, বাংলাদেশ শ্রীলংকার মতো সংকটের দিকে এগোচ্ছে। যে সংকট জনগণকে রাজপথে নামাবে সরকারকে উৎখাতের জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তুলে ধরেছে, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের অর্থনীতির ফারাক বিশাল। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরাও বারবার বলে আসছে, শ্রীলংকার সঙ্গে সে দেশের পরিস্থিতির তুলনা করা অযৌক্তিক। কারণ শ্রীলংকার অর্থনীতি প্রধানভাবে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। মহামারীর কারণে এই খাতে ধস নামে। ফলে দেশটির রিজার্ভ কমতে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানিকৃত জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে রিজার্ভ প্রায় তলানিতে এসে ঠেকে। বিপরীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হলো তৈরি পোশাক রপ্তানি এবং বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক শক্তিশালী। মহামারীর শুরুর দিকে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, অনেক প্রবাসী কাজ হারানোর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমবে। যদিও সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সফলতায় অনেক বাংলাদেশি বিদেশে তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরেছেন এবং প্রাক-মহামারী সময়ের হারে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন।
আবার শ্রীলংকার জনগণের ব্যাপক ক্ষোভের আরেকটি বড় কারণ ছিল ক্ষমতাসীন রাজাপাকসের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের ব্যাপক দুর্নীতি। বাংলাদেশেও দুর্নীতি একটি ইস্যু হলেও এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ ওঠেনি। ফলে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
মহামারী-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতি দেখলে বোঝা যায়, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে কিছু আর্থিক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তারপরও স্বল্প মেয়াদি কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে, মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে, মহামারীর দুই বছরে মন্থর গতির কারণে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের কমে নেমে এসেছে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ জারি এবং জ্বালানির মূল্য সহনশীল রাখতে সরকার চাপে রয়েছে। কিন্তু সাময়িক সংকট মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ কার্যকর হওয়া উচিত। এরই মধ্যে সংকট মোকাবিলায় সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব যতদিন থাকবে, ততদিন এভাবেই মিতব্যয়ী হতে হবে।