রাতভর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা সমাধানে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পক্ষ থেকে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিএম কলেজে আটক ৬ শিক্ষার্থীকে নিজেদের জিম্মায় নিয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এদিকে সরকারি ব্রজমোহন কলেজ ক্যাম্পাসে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নিরাপত্তায় বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। এই ঘটনায় ১০০ মত আহত হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ঘটনার সূত্রপাত নগরীর ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডের বাসিন্দা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভা চৌধুরী জোয়ার পরিবারের সঙ্গে জমি নিয়ে পার্শ্ববর্তী পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ নিয়ে। সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) রাতে বিএম কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী বিরোধ নিরসনে তাসনুভার বাসায় গেলে সেখানে কথা কাটাকাটি হয়। তাসনুভা এ সময় ফোনে ববি শিক্ষার্থী তার বন্ধুদের জানালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩০/৪০ জন সেখানে যায়। মা এবং তাকে হেনস্থা অপমান করা হয়েছে বলে তাসনুভা তাদেরকে জানালে তারা সংখ্যায় কম থাকা বিএম কলেজ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে মারধর ও কয়েকজনকে আহত করে। পরে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে চলে আসে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা নগরের বিভিন্নস্থানে ববি শিক্ষার্থীদের খুঁজতে থাকে। মঙ্গলবার বিকালে পাল্টাপাল্টি মানববন্ধনও করা হয়। মঙ্গলবার রাত ১০টায় নাগাদ নগরীর বটতলা এলাকায় ববির ২ শিক্ষার্থীকে পেয়ে মারতে থাকে তারা। তখন প্রাণ বাঁচাতে ওই দু’জন দৌড়ে পাশেই থাকা বটতলা পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকে আশ্রয় নেয়।
সহপাঠীদের মারধর করার খবর পেয়ে রাত ১২টায় নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০/৫০ জন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে করে সেখানে গেলে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা সেই বাসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও চালকসহ ১৫/২০ জনকে আহত করে। সহপাঠীদের মারধর করার খবর পৌঁছলে বাস ট্রাক বোঝাই হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে বরিশাল নগরীর বাংলাবাজার এলাকায় জড়ো হয়। সেখান থেকে আরও প্রায় ২ কিলোমিটার হেঁটে তারা বিএম কলেজে গিয়ে হামলা চালায়। এ সময় সঙ্গে করে ট্রাক ভর্তি পাথর, বেশ কয়েকটি থ্রি হুইলার ভর্তি ইটের টুকড়া, লাঠি, হকিস্টিক নিয়ে যায় ববি শিক্ষার্থীরা। এছাড়া সবার হাতেই ছিল রড পাইপ লাঠি আর ধারালো অস্ত্র।
রাত ১টা থেকে পৌনে ৩টা পর্যন্ত বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে প্রশাসনিক ভবন, আবাসিক তিনটি হল এবং শ্রেণি কক্ষে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় তারা। হামলার প্রথম পর্যায়ে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা পাল্টা হামলা চালানোর চেষ্টা করলেও সংখ্যায় অনেক কম হওয়ায় খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। এরপর বিএম কলেজের পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে ব্যাপক ভাঙচুর তাণ্ডব চালায় ববি শিক্ষার্থীরা। ভাঙচুর চালানো হয় আবাসিক হলগুলোর প্রায় সকল কক্ষ। প্রশাসনিক ভবনেও চালানো হয় তাণ্ডব। ভাঙচুর করা হয় কলেজের ৪টি বাস। রাত পৌনে ৩টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। প্রায় ১ ঘণ্টা চেষ্টার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় তারা। তবে বিএম কলেজের আশে পাশে তখনও হামলা পাল্টা হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছিল।
এদের মধ্যে অন্তত ২৩ জনকে প্রথম পর্যায়ে বরিশাল শেরে বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হামলা চালাতে গিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষার্থী বিএম কলেজের ভেতরে আটকা পড়ে এবং তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না বলে ভোরে সেনাবাহিনীকে জানায় ববি শিক্ষার্থীরা। সকাল ৮টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিএম কলেজ এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তবে কলেজের পেছনে হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছিলে সকাল সাড়ে ৫টার দিকেও। সেনাবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, নগরীর ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডে একপক্ষ বাড়ি দখল করতে ভাড়া করে নিয়ে গিয়েছিল বিএম কলেজের সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া মোস্তাফিজুর রহমান রাফিকে। সেখানে গিয়ে রাফি ও তার সঙ্গে থাকা লোকজন বাড়ির মূল মালিকদের ওপর হামলা করে। সেখানে হামলার শিকার হয় আমাদের শিক্ষার্থী তানসুভা। খবর পেয়ে আমরা ওই রাতেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হামলার কারণ জানতে চাইলে আমাদের ওপরও হামলার চেষ্টা করে রাফি। পরে থানায় জিডি করেন জোয়া। মঙ্গলবার রাত ১০টায় আমাদের দুই শিক্ষার্থীকে নগরীর বটতলা এলাকায় পেয়ে বেধরক মারধর করে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা, এই দুই ঘটনা মিলেই ঝামেলা হয়েছে। আমাদের ৬ জন শিক্ষার্থীকে আটকে রেখেছিল বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা, পাশাপাশি আমাদের বাসও ভাঙচুর করা হয়েছে। সশস্ত্র হামলায় আমাদের অনেকে আহত হয়েছে। আমরা বিএম কলেজে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানিয়েছি সেনাবাহিনীর কাছে।
বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, বেশ কয়েকদিন যাবৎ এক মহিলা বিএম কলেজে এসে সমন্বয়কদের সহায়তা চাচ্ছিলেন তার বাড়ি দখল করা হয়েছে জানিয়ে। তো সেই অনুরোধের প্রেক্ষিতে সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর রহমান ওই মহিলার বাড়িতে তার প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনার জন্য যান। তবে বাড়িতে যাওয়ার সাথে সাথেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী পরিচয় দেওয়া জোয়া সমন্বয়কদের গালাগাল করে। পরে তানসুভা তার বয়ফ্রেন্ডকে কল করলে সে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস ভরে ঘটনাস্থলে এসে বিএম কলেজের সমন্বয়কের ওপর হামলা চালায়। এরপর মঙ্গলবার রাত ১০টায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র বটতলা এলাকায় চাঁদাবাজী করা অবস্থায় হাতে নাতে আমরা আটক করি। তাদের আটক করায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে সশস্ত্র। আমাদের তিনটি বাস, প্রশাসনিক ভবন, ক্লাস রুম, তিনটি হলে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। ভাঙচুর করা হয় বিএম কলেজ এলাকার দোকানপাটও। দুইটা পারিবারিক বিষয় যে সংঘর্ষের রুপ দিয়েছে সেটি আমরা মোটেই মেনে নিতে পারছি না। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল। এই হামলার সমুচীন জবাব আমরা খুব দ্রুতই দেব। এই ঘটনায় আমাদের প্রায় ৪৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ডক্টর উন্মেষ রয় বলেন, হামলায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছে। এখন ৩৩ জনের মতো ভর্তি রয়েছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়েছেন।
এদিকে সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে বিএম কলেজ এলাকা ত্যাগ করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া নিখোঁজ থাকা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ শিক্ষার্থীকে বুঝে পেয়েছে ভারপ্রাপ্ত ভিসি মুহসীন উদ্দিন। বিএম কলেজ অধ্যক্ষ আমিনুল হক ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভিসি মুহসীন উদ্দিনের যৌথ স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি বুধবার সকাল ৮টায় এ প্রতিবেদকের কাছে আসে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি বিএম কলেজে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেই সকল ব্যয় বহন করবে এবং বিএম কলেজ কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থীকে বুঝে নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছয় শিক্ষার্থী বিএম কলেজে হামলা করতে গিয়ে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে আটক হয়। তাদের কলেজের কেন্দ্রীয় মসজিদে রাতভর আটকে রাখা হয়, পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
প্রসঙ্গত, সরকারি ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ১২ হাজারের মতো। রাতে ক্যাম্পাসে ঢুকে হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বরিশালের সাধারণ মানুষ। তাদের আশঙ্কা এই ঘটনা আরও অনেক দূর গড়াবে।