বিভাগীয় নগরী রক্ষায় কীর্তনখোলা নদীর পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে শহর রক্ষা বাঁধ। তবে নির্মাণের সাত বছরের মধ্যেই বাঁধের একাধিক স্থান দেবে ও ধসে গেছে। এতে করে ভারি বর্ষণসহ উজানের ঢল সামাল দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে বাঁধটি। ফলে বর্ষা মৌসুম আসার আগেই আতঙ্কিত হয়ে দিন পার করছেন নদী তীরের মানুষ।
দীর্ঘদিন ধরে এমন অবস্থা থাকলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড বা বরিশাল সিটি করপোরেশন। বাঁধসংলগ্ন এলাকার মানুষের দাবি, নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেই তা লোকালয়ে প্রবেশ করে তলিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বরিশাল নগরের ৩০ গোডাউন বধ্যভূমি সংলগ্ন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের পেছনের গেট সংলগ্ন, মেঘনা তেলের ডিপো সংলগ্ন, চাঁদমারি খেয়াঘাট ও মুক্তিযোদ্ধা পার্কের আশপাশে বেশ কিছু জায়গায় ভঙ্গুর সিসি ব্লক আর বালু সরে বাঁধ দেবে গেছে। আর এরমধ্যে চাঁদমারি খেয়াঘাট এলাকার কিছু জায়গায় বাঁধ ভেঙ্গেই নদীতে তলিয়ে গেছে।
নগরের বিনোদন কেন্দ্রে রূপ নেওয়া ৩০ গোডাউন সংলগ্ন নদী পারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কালু বলেন, ৩০ গোডাউন, এপিবিএন ও মেঘনা ডিপোর পেছনসহ চাঁদমারি এলাকায় বাঁধের নিচের মাটি-বালু সইর্যা গিয়া ডাবজে অনেক দিন হইছে। দিন যতো যাইতাছে, অতো খারাপ অবস্থা হইতাছে। কিন্তু কেউ ঠিক করতে আসে না। এহন ঠিক না করলে, কয়দিন পর বাঁধের ওপরের রাস্তাও ভাইঙ্গা যাইবে, তহন কিন্তু অনেক টাহা খরচ কইর্যা ঠিক করা লাগবো। এহন করলে কোম টাহায় করতে পারতো।
বশির নামে চাঁদমারী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা জানান, বছর তিন-চারেক ধরে বাঁধের এমন বেহাল দশা। তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাঁধ সংস্কার না হলে স্থানীয়রা বিপদে পড়বেন বলেও জানান তিনি।
বরিশাল সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পারে সাগরদি খালের মুখ থেকে চরকাউয়া খেয়াঘাট পর্যন্ত শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ২৫ কোটি টাকা দিয়ে বাঁধ ও বাকি টাকা দিয়ে বাঁধের ওপর সড়ক নির্মাণ করা হয়। নদী দখলের অভিযোগ ওঠায় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নেওয়ায় হাইকোর্টে একটি রিট হলে, সে বছরই শেষ পর্যায়ে থাকা বাঁধের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে সাগরদি খালের মুখের ছোট ব্রিজ ও শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতুর নিচ পর্যন্ত বাঁধ ও সড়কের কাজ ঝুলে গেছে। পরবর্তীতে যতটুকু বাঁধ নির্মাণ হয়, তার ওপরেই সড়ক তৈরি করে সিটি করপোরেশন।
বর্তমানে বাধটি সংস্কার বা পুনঃনির্মাণে নতুন করে বরাদ্দের পাশাপাশি দ্রুত কাজ করার কথা জানিয়েছে সিটি করপোরেশন। বর্তমান পরিষদের প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন লিটু জানান, জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ রক্ষা করার জন্য এ খাতে ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্রয়োজনে এ বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি হবে। এদিকে বরিশাল নগরের মতো বর্ষা মৌসুম আসার আগেই আতঙ্কিত দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার নদী পাড়ের মানুষ। টেকসই বাঁধ না থাকায় প্রতিবছরই বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে ক্ষতি হয় ঘরবাড়ি, ফসলি জমি। বাঁধ সংস্কারে কার্যকরী উদ্যোগ না থাকায় ক্ষোভ রয়েছে ভুক্তভোগীদের।
নদী খাল বাঁচাও আন্দোলন কমিটির জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর বরিশাল বিভাগের বাঁধগুলোর তেমন কোনো সংস্কার হয়নি। সেইসঙ্গে সর্বশেষ ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে বিভাগের প্রায় ১০০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাঁধগুলো টেকসই না থাকায় সামান্য দুর্যোগে ফসলের জমি, মাছের পুকুরসহ মানুষের ঘরবাড়ি তলিয়ে প্রতিবছরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু। তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো রক্ষার জন্য কোনো বাঁধই সেইভাবে নির্মাণ করা হয়নি। এ সময় তিনি এসব অঞ্চলের বাঁধগুলো সঠিকভাবে নির্মাণ করার দাবি জানান।
এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশাল সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো সংস্কার বা পুণঃনির্মাণে বিভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। যা ১-২ বছরের মধ্যে শেষ হবে। এছাড়া আরও কিছু প্রকল্প প্রণয়ন করে প্লানিং কমিশনে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হলে সেগুলোর কাজও শুরু হবে।
এছাড়া, পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগে তিন হাজার ৪২৬ কিলোমিটার বাঁধ আছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ আছে একহাজার ৬০২ কিলোমিটার। বিভাগের ছয় জেলার বিভিন্ন নদীতে ভাঙন রোধ ও বাঁধ নির্মাণের ১২টি প্রকল্প চলমান। এছাড়া প্রস্তাবিত আছে আরও ৮টি প্রকল্প।