গতকাল খবরের কাগজে লটারির ফলাফল প্রকাশ হইয়াছে কিন্তু সকাল হইতে না হইতে কান্তি বাবুর বাড়িতে মানুষের ঢল দেখিয়া আমারও চোখ কপালে উঠিল, কিন্তু কি হইয়াছে তাহা বুঝিতে পারিতেছি না। ইহার মুখে, উহার মুখে, তাহার মুখে শুধু শুনিতেছি লটারির কথা।অবশেষে ভালো করিয়া কর্ণে আসিল,কান্তিবাবু লটারি পাইয়াছেন। টাকার পরিমান ঢের বেশি। বিশ লক্ষ টাকা।
এমন খবর শুনিয়া পাড়ার লোকেরা কান্তিবাবুকে একনজর দেখিবার জন্য আসিয়াছে।কেননা এমন ভাগ্য কয়জনার কপালে জুটিয়া থাকে। কেউ কেউ যেন তাহাদের কপালখানা একটু ঘষিলে তাহাদের লটারি বাঁধিতে পারে তাই কান্তিবাবুর কপালখানায় তাহাদের কপালখানা একটু ঘষিয়া লইতেছে। বাড়ির সবাই আনন্দে নাচিতে লাগিল।কিন্তু কান্তি বাবুর মনখানা ভালো নেই তাহা পরিষ্কার বোঝা যাইতেছে। এমন খবর পাওয়ার পর আনন্দে আত্মহারা হইয়া যাওয়ার কথা, কিন্তু বাড়ি ভর্তি মানুষ দেখিতেছে তাহার মনখানা ভার করিয়া মুখে হাত লাগাইয়া বসিয়া রহিয়াছেন।
এদিকে লটারির টাকা কোন্ কোন্ কাজে খরচ করিবেন তাহাই পুত্র-কন্যা,স্ত্রী আর ভ্রাতাদের মধ্যে হিসাব চলিতেছে।মস্ত বড় ফর্দ হইয়াছে। পুত্র দামী হোন্ডা কিনিবে।কন্যা দামি জামা-কাপড় কিনিবে।স্ত্রী কয় প্রকারের গহনা গড়াইবেন তাহা লইয়া জল্পনা, কল্পনা চলিতেছে।বড় কপাল করিয়া আসিয়াছ কান্তি।নয়ত এত টাকা কেউ লটারি পায়? কতকজনায় কত কথা বলিয়া চলিতেছে।কেউবা আবার হিংসায় জ্বলিতে লাগিলেন।এতকিছুর পরেও কিছুতেই মনখানা কান্তিবাবুর ভালো লাগিতেছে না।
এমন অবস্থায় মুখে হাত দিয়া বসিয়া থাকিবার কারণটা জানিবার জন্য সকলে উদগ্রীব হইয়া উঠিল।
তখন একটু বিমর্ষ মনে কাঁদো কাঁদো হইয়া তিনি বলিলেন,
“যে লটারিখানায় বিশ লক্ষ টাকা বাঁধিয়াছে তাহা বাসের কভারে গুঁজিয়া রাখিয়াছিলাম” হারাইয়া যাইতে পারে তাই নম্বরটা মুখস্থ করিতেছিলাম।তখন বুঝিবার পারি নাই আমার কপালটায় লটারি বাঁধিবে। হঠাৎ করিয়া একজন বন্ধুর সহিত দেখা হইল, তাই সামনের সিটের পিছনের কভারের মধ্যে লটারির কাগজখানা গুঁজিয়া রাখিয়াছিলাম। গল্পে গল্পে নামিবার সময় লটারির কাগজখানা সিটের কভারেই রাখিয়া আসিয়াছি।এমন সব্বোনাশের কথা শুনিয়া উপস্থিত সকলের চোখ কপালে উঠিল।এ কথা-এ মুখ হইতে সে মুখ ছড়াইয়া পড়িল। সাংবাদিকের কর্ণে প্রবেশ করিল।দলে দলে সাংবাদিক আসিলেন, কথাগুলো শুনিলেন। বিভিন্ন চ্যানেলে তাহা ফলাও করিয়া দেখাইতে লাগিলেন। খবরটা বাতাসের মত চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল।কান্তিবাবু যেন রাতারাতি হিরো হইয়া উঠিলেন।
সরকার প্রধানের কর্ণে সংবাদটি যাইতেই নির্দেশ হইল, সমস্ত বাস মালিক যেন ইহা চেক করিয়া দেখেন। এদিকে, এ খবর সকল বাস মালিক জানিতে পারিলেন। কাহার বাসে থাকিতে পারে বিশ লক্ষ টাকার কাগজখানা তাহা ভাবিয়া সকলে গোপনে নয়ত প্রকাশ্যে বাসের সিটের কভার খুলিয়া খুলিয়া চেক করিতে লাগিলেন।
বিশ লক্ষ টাকার লটারি বলিয়া কথা।
কান্তিবাবু চিন্তায় থাকিলেন এটা ভাবিয়া যে,সরকারের নজরে ব্যাপারখানা আসিয়াছে। তিনি নিশ্চিন্ত থাকিলেন যে, তাহার মনের ইচ্ছাখানা এইবার পূরণ হইতে যাইতেছে। এ ব্যাপারখানা লইয়া রীতিমতো তোড়পাড় চলিতেছে।শুধু কানাঘুষা চলিতেছে, কাগজখানা পাওয়া গিয়াছে কিনা।কয়েকদিনের খবরের প্রধান বিষয় হইয়া উঠিল এই বিষয়টা।কিন্তু বাস মালিকদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী লটারির কাগজখানা পাওয়া যাইতেছে না।
হাত হইতে অল্পের জন্য এতগুলো টাকা চলিয়া গিয়াছে ইহা কান্তি বাবুর পরিবার যেন কিছুতেই মানিয়া লইতে পারিতেছে না। নানারকম কথার প্যাঁচে সারাক্ষণ তাহাকে মারিতে লাগিল।কিন্তু কান্তিবাবু যেন কোন চিন্তা করিতেছেন না।
এদিকে, কয়েকদিন পর হঠাৎ করিয়া টিভিতে সবাই দেখিলেন, বিশ লক্ষ টাকার আসল মালিক পাওয়া গিয়াছে। তিনি প্রমাণসহ টাকা তুলিয়া নিয়াছেন। তিনি সাক্ষাৎকারে বলিলেন, প্রথম হইতেই লটারির কাগজখানা তাহার কাছেই ছিল।তিনি টাকা দিয়া লটারির কাগজখানা কিনিয়াছিলেন।
তাহা হইলে কান্তিবাবুর কয়েকদিনে ঘটিয়া যাওয়া ঘটনার আসল রহস্য কী? এমন মিথ্যা কথা আর এমন কাহিনী ঘটানোর আসল কারণ কী?সকলেই এক মুখ হইতে আরেক মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিল। তবে কি কান্তিবাবুর এ সব নাটক ছিল।
এদিকে কয়েকদিনে বাসের সিটকভারগুলো খোলা হইল, আর খোলা হইল বলিয়া বাস কতৃপক্ষ একবারে বাসের কভারগুলোকে কাচিয়া পরিষ্কার করিয়া ফেলিলেন
সকলকে এ রকম নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইবার কারণটা কি ছিল তাহাই জানিতে পুলিশ দিয়া তাহাকে ধরিয়া আনিবার নির্দেশ হইল। আবার সাংবাদিক আসিলেন,রহস্যখানা জানিবার জন্য তাহারা ভিড় করিলেন।
এবার মুখ খুলিলেন কান্তিবাবু।বলিলেন, বাসের সিটকভারগুলো বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া ধোঁয়া হয় না।কেউ নাক ঝাড়িয়া মুছিয়া থাকে।আবার কেউবা এইটা-ওইটা খাবার খাইবার পর হাত মুছিয়া থাকে, আর ধুলা-ময়লায় সিটে বসিতে চাহিলে মনের মধ্যে খ্যাচ করিয়া ওঠে। তাই সিটগুলোকে খোলার পরে যেন তাহা ধৌত করেন সেই কারণে আমি এই নাটক করিয়াছি।
সকলের মঙ্গল কামনায় যদি আমার বড় কোনো অপরাধ হইয়া থাকে, তাহা হইলে যে শাস্তি আমার মাথায় চাপাইবেন, আমি তাহাই মানিয়া লইব।
সকলেই ভাবিল, চিন্তাখানা মন্দ ছিলনা। কিন্তু কান্তিবাবু এতবড় একখানা ষড়যন্ত্র মাথায় করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন, তাহা ভাবিয়া আমি হতবাক হইয়া যাইতেছি। যাই হোক,লটারির কারণে সকল বাসের সিট কভার তো পরিস্কার হইল।সরকার সবদিক বিবেচনা করিয়া কান্তিবাবুকে ক্ষমা করিয়া দিলেন।
পরদিন স্ব-চোক্ষে প্রত্যক্ষ করিতে দূর পাল্লার বাসে রওনা হইলেন কান্তিবাবু। বেশ কিছু বাসে তিনি উঁকি দিয়া দেখিলেন, বাসের সিটকভারগুলো নতুনের মত চকচকে পরিষ্কার দেখাইতেছে।ইহা দেখিয়া কান্তিবাবু মনে মনে স্বস্তির হাসি হাসিলেন।আবার কি নাটকে ভবিষ্যতে সিটকভারগুলো কাঁচাইবেন তাহাই আরাম করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন।হঠাৎ করিয়া বলিয়া উঠিলেন “মনে পড়িয়াছে।
লেখিকা কবি সাহিত্যিক-
শোভা রানী বিশ্বাস
সিনিয়র পরিচালক,জাকপ।
সহ সভাপতি, জাকপ লেখিকা পরিষদ ও
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি।
প্যানেল পরিচালক জাকপ ।