নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলার বিচার শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা শুনানি করতে হবে। মামলার ধার্য তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতি জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন), সিভিল সার্জনের একজন প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। এগুলো হাইকোর্টের নির্দেশনা। কিন্তু বাস্তবে নারী নির্যাতনের কোনো মামলার বিচার শুরু হলে একটানা
শুনানি হচ্ছে না। ধার্য তারিখে সাক্ষীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার ও তদন্ত বিষয়ে হাইকোর্ট দফায় দফায় এমন অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন। সঠিকভাবে মামলার তদন্ত ও দ্রুত বিচার শেষ করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার ছড়াছড়ি থাকলেও বাস্তবে এসব নির্দেশনার কোনো প্রয়োগ নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চ ২০১৬ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের ও তদন্তের ক্ষেত্রে ১৮ দফা নির্দেশনা সংবলিত একটি নীতিমালা করে তা অনুসরণের নির্দেশ দেন। এ ছাড়া আইনে নির্ধারিত সময়ে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ না হওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করে হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ২০১৮ সালে সাত দফা নির্দেশনা সংবলিত একটি নীতিমালা করে দেন। কিন্তু এসব নীতিমালা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাইকোর্টের দুই বেঞ্চ থেকে দেওয়া দুটি নীতিমালা অনুসরণ করলেই নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত ও দ্রুত বিচার সম্ভব হতো। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় এসব মামলার বিচার ও তদন্তের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা কাটছে না।
জানতে চাওয়া হলে রিটকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ১৮ দফা নির্দেশনা ছিল মূলত মামলা দায়ের ও তদন্ত বিষয়ে। এরপর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের দেওয়া সাত দফা নির্দেশনা ছিল মূলত এ ধরনের মামলার বিচার পর্যায়ের জন্য। দুটি রায়ের উদ্দেশ্য ছিল, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার যাতে সঠিকভাবে তদন্ত হয় এবং আইন অনুযায়ী দ্রুত বিচার হয়। কিন্তু এগুলো পালন হচ্ছে না। নির্দেশনাগুলো অনুরসণ করা হলে নারীর ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ বাড়ত।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদা আক্তার তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, বিচার শুরু হলে একটানা শুনানি কোনো দিনই হয় না। লম্বা লম্বা তারিখ দেওয়া হয়। অনেক সময় সাক্ষী হাজির হয় না। আপস করে ফেলে। আবার আইনজীবীরা সময় চান। সময় না দিলে আদালতকে প্রেশার দেন। অনেক সময় থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। আবার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিচারকের অভাব রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে বিচার শেষ হতে অনেক সময় লেগে যায়। তিনি আরও বলেন, সাক্ষীর নিরাপত্তা ও হাজির করার জন্য মনিটরিং কমিটির মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই বললেই চলে। আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেই ফোন করে সাক্ষী হাজির করি। হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে চললে এবং সবাই আরও সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন করলে বিচারে গতি আসবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
জানা যায়, ২০১৫ সালের ২১ মে রাতে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মাইক্রোবাসের মধ্যে এক গারো তরুণী গণধর্ষণের শিকার হন। পরে এ ঘটনায় মামলা করতে গেলে বিভিন্ন থানায় ঘুরে ঘুরে পুলিশের অসহযোগিতার কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয় তার অভিভাবকদের। মামলা গ্রহণ, চিকিৎসা ও মেডিকেল টেস্টের ক্ষেত্রে দীর্ঘ বিলম্ব হয়। পরে এ ঘটনায় ব্লাস্টসহ পৃথক পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করে। ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ রায় দেন। রায়ে ধর্ষণ মামলার বিচার ও তদন্তের ক্ষেত্রে ১৮ দফার নির্দেশনা দেন।
ওই রায়ে হাইকোর্ট ধর্ষণের ঘটনায় মামলা দায়ের ও তদন্তের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন না হওয়া পর্যন্ত সংশ্নিষ্টদের এ ১৮ দফা নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়। এ ছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা তৈরি করতে আইন মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ মহাপরিদর্শককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও বলা হয় রায়ে।
১৮ দফার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের অভিযোগের ক্ষেত্রে বিলম্ব না করে থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে (ডিউটি অফিসার) দ্রুত লিখিত অভিযোগ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট থানার আওতায় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে কিনা, তা বিবেচনা করতে গিয়ে কোনো রকম বৈষম্য বা বিলম্ব করা চলবে না। অবিলম্বে এ -সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইট খুলতে হবে, যেখানে অভিযোগকারী তার অভিযোগ বা তথ্য অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারবেন। কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিলম্ব বা অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন না। কনস্টেবলের নিচে নয় এমন একজন নারী পুলিশ প্রতি থানায় ২৪ ঘণ্টা রাখতে হবে। ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধের তথ্য নেওয়ার কাজটি করবেন একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা। আর তা করতে হবে ভুক্তভোগী, ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্য অথবা ভুক্তভোগীর পছন্দমতো কারও উপস্থিতিতে। নিরাপত্তা কর্মকর্তা, সমাজকর্মী, আইনজীবী অথবা ভুক্তভোগীর মনোনীত কারও উপস্থিতিতে ভুক্তভোগীর জবানবন্দি গ্রহণ কতে হবে। লিখিত তথ্য গ্রহণের পর বিলম্ব না করে তদন্তকারী কর্মকর্তা থানায় উপস্থিত একজন নারী পুলিশের সঙ্গে ভুক্তভোগীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন। ভুক্তভোগীকে দ্রুত সারিয়ে তোলার জন্য ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমূলক সব মামলায় বাধ্যতামূলকভাবে রাসায়নিক বা ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে। কথিত অপরাধ সংগঠনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেনসিক ল্যাব বা ডিএনএ প্রোফাইলিং সেন্টারে পাঠাতে হবে। তথ্য সংগ্রহে বা ভুক্তভোগীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও পরামর্শের জন্য প্রত্যেক মহানগরে একটি করে সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
দ্রুত বিচার শেষ করতে সাত দফা : এদিকে আইনে নির্ধারিত সময়ে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ না হওয়ার বিষয়টি লক্ষ করে ২০১৮ সালের ১৮ জুলাই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সাত দফা নির্দেশনা দেন। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে—আইনে নির্ধারিত সময়সীমা অর্থাৎ বিচারের জন্য মামলা পাওয়ার দিন থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করতে হবে। বিচার পর্যায়ে মামলার শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা মামলা পরিচালনা করতে হবে। মামলার ধার্য তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতি জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন), সিভিল সার্জনের একজন প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। পাবলিক প্রসিকিউটর কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকবেন এবং কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিমাসে সুপ্রিম কোর্ট, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবেন। যেসব জেলায় একাধিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে সেসব জেলায় সব ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মনিটরিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাদের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ তিনি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন। ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ সঙ্গত কারণ ছাড়া সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হলে মনিটরিং কমিটিকে জবাবদিহি করতে হবে। মনিটরিং কমিটি সাক্ষীদের ওপর দ্রুত সময়ে যাতে সমন জারি করা যায় সে বিষয়টিও তদারকি করবেন। ধার্য তারিখে সমন পাওয়ার পর অফিসিয়াল সাক্ষী যেমন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, ডাক্তার বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সন্তোষজনক কারণ ছাড়া সাক্ষ্য প্রদানে উপস্থিত না হলে ট্রাইব্যুনাল ওই সাক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ এবং প্রয়োজনে বেতন বন্ধের আদেশ প্রদান বিবেচনা করবেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, সঠিকভাবে মামলা দায়ের ও তদন্ত না হওয়ার কারণে অনেকগুলো ঘটনায় নির্যাতনের শিকার নারীরা ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে যে শূন্যতা সেটা পূরণের জন্যই হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনাগুলো এসেছিল। এসব নির্দেশনা পালন হচ্ছে কিনা তা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে দেখতে হবে। কিন্তু সেই উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। নির্দেশনাগুলো পালন না করায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।