ভোটে ইভিএম ব্যবহার কিংবা ইসি কোন ইস্যু নয় উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আবারও বলেছেন, আমাদের অবস্থান খুবই পরিষ্কার। হাসিনাকে (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে, সংসদ ভেঙে দিতে হবে এবং সরকারকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
শনিবার বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা জানান। ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ একে একে আমাদের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। সব স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের মানুষ এখন এই সরকারের কবল থেকে মুক্তি চায়। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার- বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিন, ফয়সালা হবে রাজপথে।
ফখরুল বলেন, আজ আওয়ামী লীগ বর্গীর রূপ নিয়েছে। ভোটের অধিকার নিয়ে একবার নয়, যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখনই ভোট চুরি করে। তারা সন্ত্রাস করবে, চুরি করবে এটা হয় না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভোট চুরি করে ক্ষমতায় এসেছে তারা। এখন আবার নতুন করে ভোট চুরি ফায়দা আঁটছে। নতুন বুদ্ধি এঁটে নতুন কমিশন দিয়ে আবার কৌশলে ভোট চুরির চিন্তা করছে। কিন্তু এই হাসিনা- এই সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, এখন উন্নয়ন ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু বাস্তবে গেলে কোনো কিছুতেই হাত দেয়া যায় না। আমরা মুক্তি চাই, এ থেকে পরিত্রাণ চাই। আমাদের এই আন্দোলন বিএনপির জন্য নয়; খালেদা জিয়ার জন্য নয়; তারেক রহমানের জন্য নয় কিংবা আমাদের নেতাদের জন্য নয়। এ আন্দোলন জাতি ও দেশের প্রয়োজনে সমগ্র জাতিকে রক্ষা করার জন্য।
দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে তিনি বলেন, সব টাকা পাচার করে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক সংকট, ডলারের সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু তখন মনে ছিল না- যখন টাকাগুলো চুরি করে পাচার করছিলেন, বিদেশে পাঠাচ্ছিলেন, তখন মনে ছিল না।
ফখরুল বলেন, এ সরকার দুর্নীতি করেনি, এমন একটা জায়গা দেখান। একটা চাকরিও কি তারা দিয়েছে?। দিয়েছে তবে সেটি আওয়ামী লীগের ছেলেদের। ২০ লাখ টাকা নিয়ে দিয়েছে। বিনা পয়সার সার দেয়ার কথা বলেছে। কিন্তু আমাদের থেকে তিন গুণ দেশি দামের সার দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, বিএনপির আমলে দেশে শুধু উন্নয়ন হয়। আর আওয়ামী লীগের আমলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়। বিএনপি যতদিন ক্ষমতায় ছিল ততদিন দেশে উন্নয়ন হয়েছে। এই বরিশালেও অনেক উন্নয়ন হয়েছে বিএনপির আমলে।
মির্জা ফখরুল বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দেশের সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। সবাই স্বপ্ন দেখেছিল একটি সুন্দর দেশ গড়ার। কিন্তু আওয়ামী লীগ একে একে আমাদের সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। সব স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ১৪-১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ একই স্বপ্ন দেখছে এবং তারা কাজ করছে ওইভাবে যে, তারা দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েক করতে চায়। কিন্তু গণতন্ত্রের একটা খোলস বা মোড়ক রাখতে চায়।
তিনি বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে অসংখ্য মামলা হয়েছে এবং তাদের ওপর হামলা হয়েছে। হামলা এবং মামলা হচ্ছে তাদের (আওয়ামী লীগ) একটা বড় অস্ত্র। তারা যাদের ওপর হামলা করবে আবার তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করবে।
ফখরুল বলেন, ‘আজকে দেশের আলেম-ওলামারাও রেহাই পাচ্ছেন না। তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দেওয়া হচ্ছে। তাদেরকে আটক করে জেলে রাখা হচ্ছে। কেউ নিরাপদ নয়। দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে- প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী এখন দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন কেন? এমনকি কিছুদিন আগেও তারা (সরকার) সর্বত্র উন্নয়নের দাবি করেছেন। মানুষ আর এ ধরনের উন্নয়ন চায় না।
দেশকে বাঁচাতে সব ধরনের বিভেদকে কবর দিয়ে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকার গঠন করব। আমরা জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন নই, আমরা জনগণের সঙ্গে থাকি।
বিএনপির মহাসচিবের আগে গণসমাবেশ দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামে পরিবহণের প্রয়োজন হবে না। পরিবহণ ছাড়া যে আন্দোলন হতে পারে, এটা বরিশালের জনগণ দেখিয়ে দিয়েছে। মানুষ গ্যাসের অভাবে রান্না করতে পারছে না। আমি আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যের জবাব দিতে চাই না। কারণ আমাদের মূল দাবি থেকে সরে যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষের ভোটাধিকার নাই, আইনের শাসন নাই। ফার্স্ট ডিভিশনের সঙ্গে থার্ড ডিভিশনের খেলা হতে পারে? আগে পদত্যাগ করে আসুন, মাঠে আসুন, তখন খেলা হবে। সব কিছুর মূলে হচ্ছে ভোট চুরি, আজকে গুম, খুন, হত্যার মূলে হচ্ছে ভোট চুরি। তাহলে এই ভোট চুরি রুখতে হবে।
খসরু বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়া দেশের মানুষের প্রতি সম্মান জানিয়ে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে জনগণের কাতারে নেমে এসেছিলেন। তিনি চাইলে ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার টাকা পায় না সরকার, তাদের ভোট চুরির মেশিন কেনার পয়সা আছে।
সমাবেশে ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে তাদের লালকার্ড দেখিয়েছে। সমাবেশে আসার জন্য আওলাদ নামে একটি লঞ্চ ভোলাঘাটে অবস্থান করেছিল। বর্তমান লুটেরারা লঞ্চের চেয়ার টেবিল খাওয়ারসহ সকল কিছুই লুট করে নিয়ে গেছে। এ হলো আওয়ামী লীগ সরকারের চরিত্র।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের বাক স্বাধীনতা নেই। সভা সমাবেশের স্বাধীনতা নেই। দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করে নিয়ে গেছে। সমাজ জীবনের সকল স্তরকে তাঁরা বিষাক্ত করে তুলেছে। দেশের স্বাধীনতা এখন আদুভাই। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে লালকার্ড দেখিয়েছে।
মেজর হাফিজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে আমি এবং সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান একই বাঙ্কারে ছিলাম। মাত্র একশ গজ দূরে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান শহীদ হন। আর যদি গোলাটি একশ গজ কাছে পড়তো তাহলে জিয়া শহীদ হতেন। জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। অথচ এ সরকার বলে বেড়াচ্ছে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান রাখেননি।
বিএনপির এ নেতা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে হত্যাকাণ্ড হয়েছিল তার দায়ভার চাপানো হচ্ছে জিয়াউর রহমানের ওপরে। অথচ তখনো জাতীয় সংসদ বহাল ছিল। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা খন্দকার মোশতাকের বঙ্গভবনে দফায় দফায় বৈঠক করে ক্ষমতায় বসে।
জেলহত্যার সময় সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান নিজেই গৃহবন্দি ছিলেন। অথচ আওয়ামী লীগের নেতারা বলে বেড়াচ্ছেন জিয়াউর রহমান নাকি হত্যা করেছে। দেশের মানুষ এ অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে বলে মন্তব্য করে হাফিজউদ্দিন আহমেদ।
গণসমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিমা রহমান, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যরিষ্ট্রার শাজাহান ওমর (বীর উত্তম), অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী সোহেল, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার, মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন, বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন। সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক। সঞ্চালনা করেন মহানগর সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ।