ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল ১৯৯৭ সালের ২৬ মে। এরপর একে একে কেটে গেছে দীর্ঘ ২৫টি বছর। এই সিকি শতাব্দী কারাগারেই কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। হত্যা, চাঁদাবাজি আর অস্ত্র মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে ১৫টি। তিনি ছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত তালিকাভুক্ত টপ টেরর। তার নাম সুইডেন আসলাম। জানা গেছে, একটি মামলায় জামিন পেলে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন তিনি। কিন্তু জামিনের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই তার। মূলত কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার আগ্রহ নেই। মুক্ত জীবনের চেয়ে কারাগারেই নিরাপদবোধ করছেন সুইডেন আসলাম।
জানা গেছে, ২৫ বছর কারাগারে অন্তরীণ সুইডেন আসলাম ১৫টি হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্র মামলার আসামি ছিলেন। ৩টি অস্ত্র মামলায় ১৭ বছর করে ও একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তবে তেজগাঁওয়ের যুবলীগ নেতা গালিব হত্যা মামলা ছাড়া অন্য মামলাগুলোয় খালাস পেয়েছেন।
তেজগাঁওয়ের যুবলীগ নেতা মাহমুদুল হক খান গালিব হত্যা মামলায় শেখ মো. আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম ও এসএম আরমানসহ আসামি ১৯ জন।
জানা গেছে, প্রায় এক যুগ ধরে তেজগাঁও থানার ওই মামলার কেস ডকেট (সিডি) গায়েব। এ কারণে গত ১৬ বছরে মামলাটির বিচার থমকে আছে। ওই সময়ের মধ্যে আদালত একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যও গ্রহণ করতে পারেননি। ২০১৯ সালের ২৫ জুন এ মামলায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিতে এলেও মামলার সিডি না থাকায় সাক্ষ্য নিতে পারেননি আদালত। ফলে ২৫ বছর আগের এই হত্যার বিচার থেমে আছে।
মামলাটি বর্তমানে ঢাকার ২ নম্বর বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামানের আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ২ অক্টোবর ধার্য তারিখে সাক্ষী না আসায় আদালত ৫ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ঠিক করেছেন।
মামলাটি এর আগে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ছিল। ওই আদালতে থাকার সময় ২০০৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চুন্নু মিয়া নামে একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। এরপর মামলাটির সিডি গায়েব হওয়ায় আর সাক্ষ্য হয়নি। ওই সময়ের মধ্যে চার্জশিটের ২৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়।
সিডি গায়েব সম্পর্কে ঢাকার ২ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর ফরিদউদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০১১ সালে মামলার নথি দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে আমাদের আদালতে পাঠানো হয়। কিন্তু সঙ্গে সিডি পাঠানো হয়নি। অনেকবার সিডির জন্য পিপি অফিসে লিখিত আবেদন দিয়েছি। কিন্তু সিডির কোনো ট্রেস পাওয়া যায়নি। সিডি ছাড়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ করা সম্ভব নয়।
মামলার নথিতে আসামি সুইডেন আসলামের আইনজীবী হিসেবে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সাইদুর রহমান মানিকের নাম রয়েছে। তার বক্তব্য, এ মামলা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তাই এ মামলা সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন না।
মামলার নথিতে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরও সুইডেন আসলামের পক্ষে জামিনের আবেদন করা হয়, যা আদালত নামঞ্জুর করেন। এরপর গত ৮ বছরে তার আর জামিনের আবেদন করা হয়নি। তবে মামলায় ২০২১ সালে আদালতে আসামির পক্ষে সুচিকিৎসার আবেদন করা হলে আদালত জেল কোডের বিধান অনুযায়ী চিকিৎসার নির্দেশ দেন। চিকিৎসার আবেদনে বলা হয়- সুইডেন আসলাম ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত।
নথি থেকে দেখা যায়, মামলাটির আসামি ওয়াদুদ মাস্টার, নবী সোলাইমান, সাইফুল ইসলাম নিরবের নাম রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আদালতে আবেদনও করা হয়। কিন্তু আদালত আসামিরা এজাহারনামীয় মর্মে ২০০৪ সালের ১১ জুলাই প্রত্যাহারের আবেদন নামঞ্জুর করেন।
সূত্র জানায়, সুইডেন আসলাম বর্তমান সরকারের সময় কারাগার থেকে বের হওয়া নিরাপদ মনে করছেন না। তাই অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তিনি গত ৮ বছরে জামিনের আবেদন করেননি। এ ছাড়া দীর্ঘ ১৬ বছর সাক্ষী না হওয়ার পরও সাক্ষী ক্লোজ করে মামলাটি নিষ্পত্তির আবেদনও করেননি।
১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ তেজগাঁও থানার তেজকুনিপাড়ায় গালিবকে তার বাসার সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিতে তিনি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
মামলাটিতে স্বীকারোক্তি প্রদানকারী আসামি শাহীনের জবানবন্দি অনুযায়ী, আসামি দেলু ও মাসুদ সুইডেন আসলামের নির্দেশে ও উপস্থিতিতে গালিবকে গুলি করে। নিহতের স্ত্রী শাহেদা নাসরিন শম্পা তেজগাঁও থানায় ঘটনার দিনই মামলা করেন। ১৯৯৯ সালের ৮ এপ্রিল ডিবি ইন্সপেক্টর এসএ নেওয়াজী আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।
চার্জশিটে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামসহ ১৯ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ২০০৩ সালের ১৫ অক্টোবর আদালতে শম্পার সাক্ষ্য দেওয়ার মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়।
ডিবির তৎকালীন ইন্সপেক্টর এসএ নেওয়াজী, পরিদর্শক মতিউর রহমান, তৎকালীন সহকারী কমিশনার রফিকুল ইসলাম ও তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক শাহ আলমসহ ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ এখনো বাকি আছে।
সুইডেন আসলাম ও এসএম আরমান ছাড়াও মামলার অপর আসামিরা হলেন মানিক, বাদশা ওরফে বদিউজ্জামান, এহসানুল হক রুবেল, নবী সোলায়মান, আনোয়ার ওরফে আনোয়ারুজ্জামান, সাইফুল আলম নিরব, আজিজুর রহমান লিটন ওরফে কুত্তাচোরা লিটন, শাহীন, শফিকুল আলম ফিরোজ, এসএম রাকিবুজ্জামান রাকিব, দুলাল ওরফে আব্দুস সাত্তার, আবু তাহের সিদ্দিক ওরফে তরু, দেলোয়ার হোসেন দেলু, ল্যাংড়া মাসুদ, স্বপন, হাসান ইমাম ওরফে বাবু ও সাদেকুল ইসলাম সাগর।
আসামিদের মধ্যে কারাগারে আছেন সুইডেন আসলাম, শাহীন ও আরমান। জামিনে আছেন আজিজুর রহমান লিটন ওরফে কুত্তাচোরা লিটন, বাদশা, মানিক, রুবেল, আনোয়ার ও সাইফুল। অপর আসামিরা পলাতক। মামলায় ওয়াদুদ মাস্টার ও নবী সোলায়মান মারা গেছেন।
আসলামের বাবার নাম শেখ মোহাম্মদ জিন্নাত আলী। পরিবারটির আদি বাস ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার আগলা ইউনিয়নের ছাতিয়া গ্রামে। তবে পরিবারের কেউ এই গ্রামে থাকেন না। আসলামের বাবা-চাচারা স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকার ইন্দিরা রোডে বসবাস শুরু করেন। স্বাধীনতার পর জিন্নাত আলী ফার্মগেটে রড-সিমেন্টের ব্যবসা শুরু করেন। তার তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে আসলাম দ্বিতীয়।
আসলাম এসএসসি পাস করেন তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল (বর্তমানে তেজগাঁও সরকারি বিদ্যালয়) থেকে। স্কুলজীবনে ভালো ফুটবল খেলতেন। আন্তঃজেলা স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় খেলেছেন। তেজগাঁও কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েই বনে যান বিপথগামী। সে সময় ফার্মগেট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন আজাদ-বাপ্পি নামে দুই ভাই। একদিন ফার্মগেটের নিউ স্টার হোটেল থেকে বাপ্পিকে জোর করে তুলে নিয়ে যান আসলাম ও তার লোকজন। এরপর মারধর করে রাস্তায় ফেলে দেন। এতে দুই ভাইয়ের পতন ঘটে, উত্থান হয় আসলামের। শাকিল নামের এক কিশোর হত্যার মধ্য দিয়ে আসলামের এই কাজে হাতেখড়ি বলে অভিযোগ আছে। ১৯৮৭ সালে পূর্ব রাজাবাজার নাজনীন স্কুলের ভেতরে মায়ের সামনে খুন হয় শাকিল।