দীর্ঘসময় ধরে রাজনীতির মাঠে ম্রিয়মাণ থাকা বিএনপি বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দৃশ্যত অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গত শনিবার ঢাকায় কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ের ১০টি গণসমাবেশ শেষ করেছে দলটি। কঠিন বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বিপুল জনসমাগম ঘটিয়ে এসব সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হওয়ায় এখন উজ্জীবিত দলের নেতাকর্মীরা। বেড়েছে তাদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস। ভয়কে জয় করে নেতাকর্মীদের মধ্যে ফিরে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য ও উদ্দীপনা। সাংগঠনিক এই গতি ধরে রেখে সরকার পতনের আন্দোলনে সফল হওয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায় বিএনপি।
চাল, ডাল, জ্বালানি তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভে ভোলায় নূরে আলম ও আব্দুর রহিম, নারায়ণগঞ্জে শাওন, মুন্সীগঞ্জে শহিদুল ইসলাম শাওন, যশোরে আব্দুল আলিমসহ সাতজনকে হত্যা, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বিএনপি।
প্রতিটি সমাবেশের আগে দলটিকে সম্মুখীন হতে হয়েছে নানামুখী প্রতিকূলতার। সব বাধা মোকাবেলা করে ১০টি সমাবেশ শেষ হওয়ার পরে রাজনৈতিক মহলের আলোচনা হচ্ছে এই বিভাগীয় সমাবেশগুলো থেকে বিএনপির অর্জন কি?
এই প্রশ্নের জবাবে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, গত এক যুগ ধরে তিনটি জাতীয় নির্বাচন ও আন্দোলনের মাঠে সফল না হতে পারায় বিএনপির সাংগঠনিক শক্তিমত্তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করা শুরু করেছিল। মামলা-হামলার ভারেও নেতাকর্মীরা দিশেহারা ছিল। নেতারাও কর্মসূচি না থাকায় ছিলেন নিষ্ক্রিয়। তবে একটি কর্মসূচিই এখন পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। নেতাকর্মীরা গা ঝাড়া দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মাঠের এসব কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি জনগণের বিপুল সাড়া মিলেছে। কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সহকর্মীর জীবন চলে যাওয়ার পরেও কেউ ভয়ে মাঠ ছাড়েনি। সব মিলে বিএনপি এখন পুরোপুরি আন্দোলনমুখী।
সমাবেশগুলো থেকে বিএনপির অর্জন প্রসঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, অর্জন অনেক। তবে বড় অর্জন হচ্ছে তিনটি। এক, নানা প্রতিবন্ধকতা ও উসকানি সত্ত্বেও বিএনপির সমাবেশগুলো সফল হওয়ায় ক্ষমতাসীনরা বেশ চিন্তিত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। দুই. অগোছালো বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতেও নিজেদের দৃশ্যমান করে তুলতে ও সক্ষমতা দেখাতে পারছে এবং তিন. জনগণ বিএনপির আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে নেমেছে।
দলের সিনিয়র একাধিক নেতা বলেন, এই কর্মসূচি ছিল নেতাকর্মীদের ঘরের বাইরে নিয়ে আসার কর্মসূচি, বিএনপিকে মাঠে নিয়ে আসার কর্মসূচি। ভয়হীন পরিবেশ নিশ্চিত করার কর্মসূচি। জনমত তৈরি করার কর্মসূচি। দেশবাসীকে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে জাগানোর কর্মসূচি। নেতাকর্মীরা সেই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তাদের শক্তিমত্তা জানান দিয়েছে। নেতারা বলেন, সমাবেশগুলোর মাধ্যমে নিজেদের জন্য নয়, জনতার জন্য রাজনৈতিক নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধান দাবিগুলো ছিল জনতার জন্য। এজন্য আমজনতা এগুলোকে আন্তরিকভাবেই সমর্থন জানিয়েছে। বিএনপি তার যে দাবিগুলোর ওপর ভিত্তি করে বিভাগীয় সমাবেশে দেশব্যাপী একটা শক্তিশালী জনমত তৈরি করতে চেয়েছিল তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় অর্জন। আন্দোলনে জনগণ সম্পৃক্ত হওয়ায় অঘোষিত হরতাল অবরোধ দিয়েও বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের জনসমুদ্র আটকানো যায়নি।
বিএনপির নেতারা বলেছেন, এসব সমাবেশে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে নেতাকর্মীরা এক কাতারে শামিল ছিলেন। সমাবেশগুলোতে দলটির কেন্দ্র ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের থেকে বহিষ্কৃত ও পদত্যাগকারী নেতাকর্মীদেরও অংশ নিতে দেখা গেছে। দলের সিনিয়র এক নেতা বলেন, তৃণমূলকে সম্পৃক্ত করে গণমুখী রাজনীতির যে নতুন সম্ভাবনা বিএনপি তৈরি করেছে, আগামী দিনের আন্দোলনে তা কাজে লাগবে। এর মাধ্যমে সবচেয়ে বড় যে কাজটি হয়েছে তা হলো বিএনপি এই সমাবেশের মাধ্যমে একটি ভয়হীন পরিবেশ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। বিএনপি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুন বলেন, বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে সংগঠনে নতুন গতি এসেছে। এখন প্রয়োজন এই গতি ধরে রাখা।
নেতারা বলেছেন, সমাবেশগুলো থেকে নেতৃত্বের কোনো সঙ্কট বিএনপিতে নেই তা প্রমাণিত হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বন্দী। সমাবেশগুলোতেও থাকতে পারেননি। অথচ তিনি না থেকেও যেন অনেক বেশি ছিলেন। সমাবেশ সফলে লন্ডনে থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বার্তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে প্রতিটি নেতাকর্মী। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাহসী ভূমিকাও ছিল ঘরে বাইরে প্রশংসিত। ঢাকার সমাবেশের আগে তিনি বন্দী হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয়েছে।
এ ছাড়া সমাবেশগুলোতে বড় অর্জন হচ্ছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিএনপির কর্মসূচিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। নয়াপল্টনে পুলিশের অভিযান বিবিসি, গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্ট, আলজাজিরা, ডয়েচে ভেলেসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপির প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের ইতিবাচক জনমত তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নয়াপল্টনে পুলিশি হামলার তদন্ত চেয়েছে। জাতিসঙ্ঘ এবং আমেরিকা বিবৃতি দিয়েছে। মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে চৌদ্দটি রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে।
সমাবেশগুলো থেকে দলের অর্জন প্রসঙ্গে দফতরের দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, সমাবেশগুলো থেকে দলের প্রাপ্তি অনেক। সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, চাঙ্গা হয়েছে নেতাকর্মীরা। এর ধারাবাহিকতায়ই আন্দোলন সফল হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।