সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ ছিলেন শিক্ষা সেক্টরের বিশাল এক মাফিয়া। গত মঙ্গলবার চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার হওয়ার পর এখন একে একে বেরিয়ে আসছে তার নানা অপকর্মের ফিরিস্তি। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ বিক্রির দীর্ঘ দিনের অভিযোগের নানা কাহিনীও এখন বের হচ্ছে। একই সাথে মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ এর যেসব সহযোগী এতদিন ছিলেন বহাল তবিয়তে তারাও এখন সুর পাল্টে কথা বলতে শুরু করেছেন। শিক্ষা ভবন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, শিক্ষা খাতের নানা অনিয়মের সাথে জড়িত ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ। তবে সম্প্রতি শিক্ষা মাফিয়াচক্রের অন্যতম সদস্য ও যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক বিসিএস সাধারণ ক্যাডার শিক্ষা কর্মকর্তা মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ চাকরি হারানোর পর অনেকেই এখন ভোল পাল্টে কথা বলছেন। তবে অনেকেই আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নানা অভিযোগও করছেন। অভিযোগ রয়েছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বাড়ির ফুটফরমায়েশ খাটুরে ও সাবেক এপিএস এবং জিপিএ ফাইভ বিক্রি, প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা অপকর্মের। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাত দিন আগে গোপনে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তিনি। তবে, তার সিন্ডিকেটে কিছু সদস্য এখনো গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন এবং গোপনে এখনও লুটপাট করে চলছেন।
অভিযোগা রয়েছে ছাত্র পাঠানোর নামে বিদেশে আদম পাচার ও বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ একটি কলেজের কাছে জিপিএ ফাইভ বিক্রি, প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা অপকর্মে নিযুক্ত ছিলেন বাড়ৈ। বদলি বাণিজ্য, এমপিওভুক্তি, শিক্ষা প্রকৌশলে লুটপাট এবং শিক্ষা ক্যাডারকে তছনছ করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তার অসংখ্য বান্ধবী এখনও শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে। তিনি শিক্ষা খাতের পি কে হালদার হিসেবে পরিচিত।
নুরুল ইসলাম নাহিদের পদ চলে যাওয়ার পর সরকারের অনুমতি ছাড়া দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন তিনি। শিক্ষা ক্যাডারের এ সহযোগী অধ্যাপকের বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে তারই পছন্দের ও দুর্নীতিবাজদের পদায়নের অভিযোগ আছে। কর্মস্থলে যোগদান না করে দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা হিসেবে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক সাংবাদিকদের বলেন, প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারীর অননুমোদিতভাবে বিদেশে থাকার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক সব ধাপ অনুসরণ করে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
এ দিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করলেও বাড়ৈ ২০২০ সালের খুলনার ব্রজলাল কলেজে পদায়ন পেয়েছিলেন। ২০০৯ সালে নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর টানা ৮ বছর তার এপিএস ছিলেন মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ। ওই সময় বিভিন্ন সরকারি ও শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি ও পদায়নসহ সব কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তাকে এপিএস পদ থেকে নুরুল ইসলাম নাহিদ সরিয়ে দিতে বাধ্য হন। এর পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপপরিদর্শক (কলেজ) পদে ছিলেন তিনি।
বাড়ৈকে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারি খুলনার বিএল কলেজে পদায়ন করা হয়। আদেশে তাকে ওই বছরের ১২ এপ্রিলের মধ্যে যোগদান করতে বলা হলেও বাড়ৈ যোগদান করেননি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে তাকে পলায়নে অভিযুক্ত করে শোকজ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে জানুয়ারিতে তাকে আবার শোকজ করা হয়। শোকজে মন্ত্রণালয় বলেছিল, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পদায়ন-বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান না করে অননুমোদিতভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন।
প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে এ ধরনের কার্যকলাপ সরকারি চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণবিধি পরিপন্থী এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩(খ) ও ৩(গ) অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাকে ১০ দিনের মধ্যে কর্মস্থলে যোগদান না করার কারণ লিখিতভাবে জানাতে এবং তিনি ব্যক্তিগত শুনানি চান কি না তাও জানাতে বলা হয়েছিল। তিনি প্রশাসনিক এসব প্রক্রিয়ায় যুক্ত হননি। তাই তাকে চাকরিচ্যুত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।