ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার যখন জাতীয় নির্বাচনের পথে এগোচ্ছে, তখন ডাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডাকসুসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন আগামী
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথ দেখাবে। প্রসঙ্গত, আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে বহুল প্রত্যাশিত ডাকসু নির্বাচন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি প্রযুক্তির নতুন সংযোজন আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সসহ (এআই) নানা অনলাইন মাধ্যমের প্রচার ও প্রপাগান্ডা মোকাবিলাও হবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির এবং জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের প্রার্থিতা বাতিলের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। ঢাবি প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একটি প্যানেল। নিজ সংগঠনের প্রার্থীর ফরম ওঠাতে গিয়ে মবের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে ছাত্রদল। এমন বাস্তবতায় বিভিন্ন সংগঠন ও প্যানেলের ছাত্রনেতাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বৈরিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এটি সহিংসতায় গড়ায় কি নাÑ এ নিয়েও রয়েছে আশঙ্কা। একই আশঙ্কা রয়েছে অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এরই মধ্যে সেনা মোতায়েন চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে যেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, এটি বিবেচনায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে ছাত্রনেতাদের দায়িত্বশীল আচরণ জরুরি। কারণ, মানুষ দীর্ঘদিনের দুঃশাসন থেকে কেবল বের হয়েছে। এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক মন্দ খবর মানুষ নিতে পারবে না।
প্রযুক্তি প্রতি মুহূর্তে মানুষকে আনন্দ দিচ্ছে আবার বিব্রতও করছে। ফলে এর নেতিবাচক প্রয়োগের বিষয়েও সতর্ক থাকার কথা বলেন আবুল কাশেম ফজলুল হক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, অতীতে ডাকসু নির্বাচন আগে হলে জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব পড়ত। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবারের পরিস্থিতিটাও একটু কনফিউজিং। ডাকসুতে অনেকগুলো প্যানেল প্রতিযোগিতা করছে। কাজেই এ নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচনের প্রেডিক্ট করা খুব কঠিন হবে। এর পরও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। দেখতে হবে কারা জয়লাভ করে। তিনি বলেন, একটা সময় ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি আগাচ্ছে মানে ছাত্রলীগের রাজনীতি এগোত। আবার ছাত্রলীগের রাজনীতি এগিয়ে যাওয়া মানে শেখ মুজিবের রাজনীতি আগানো। তারপর নব্বইয়ের আন্দোলনে ছাত্রদল ডাকসুতে এলো। সেটার একটা প্রভাব পড়ল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে। অতীতে এ রকম হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরীও মনে করেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে বার্তা দেয়; ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাবে জাতীয় নির্বাচন কীভাবে করা যায়, কীভাবে করতে হবে। তিনি বলেন, যারা জিতবে বা যে দলের ছাত্র সংগঠন বিজয়ী হবে, তারা জাতীয় নির্বাচনে উদাহরণ হিসেবে সামনে আসবেন। ফলে তাদের বিজয় নিঃসন্দেহে দলের জন্য বোনাস পয়েন্ট হবে। কারণ, তিনি মনে করেনÑ এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হলেও তাদের রাজনৈতিক আদর্শগত অবস্থান কিন্তু আছে।
ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, নির্বাচন যদি খুবই সুন্দর পরিবেশে হয়, ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, তবে তা পার্লামেন্ট নির্বাচনে একটা ভালো উদাহরণ হবে। ছাত্ররা যদি একটি ভালো নির্বাচন করতে পারে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারে, তাহলে জাতীয় নির্বাচন কেন শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না? এটা একটা ইফেক্ট হতে পারে। আমার প্রত্যাশা থাকবে, ছাত্ররা যেন স্বাধীনভাবে তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারে। অবাধে মতপ্রকাশ করতে পারে। কোনো রকম ভয়-ভীতির পরিবেশ থাকবে না বলেই আমরা আশা করি।
তবে কারও কারও ভিন্নমতও আছে। তারা মনে করেন ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ বিষয়ে ডাকসুর সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুরের ভাষ্য, ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে না। কারণ, সাধারণত নির্বাচিত সরকারের সময় ডাকসুতে বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো ভালো করে। এখন তো কার্যত ওইভাবে রাজনৈতিক সরকার নেই। আর আমার মনে হয় না, এখানে একক কোনো প্যানেল বিজয়ী হবে। বিভিন্ন প্যানেলের বিভিন্ন প্রার্থীর কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। বিগত বছরগুলোতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন-সংগ্রামে অনেকের ভূমিকা আছে। এ রকম শিক্ষার্থীরা বের হয়ে আসছেন। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়, একটা ভালো সমন্বয় হবে, ভালো নির্বাচন হবে এবং ভালো নেতৃত্ব বের হয়ে আসবে। তবে এ নিবাচন জাতীয় রাজনীতিতে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে বলে আমার মনে হয় না।