সোমবার, ০২:৪৭ অপরাহ্ন, ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

কজন জানে জুলাই সনদ কী

গাজীউল হাসান খান
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৭ জুলাই, ২০২৫
  • ৬ বার পঠিত
সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।

দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র মেরামত ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সংস্কারের প্রশ্নে একটি ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে বিগত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতনের পর কথিত রাষ্ট্র মেরামত কিংবা সংস্কারের দাবিগুলো দল-মত-নির্বিশেষে একটি জাতীয় কর্মসূচির রূপ পরিগ্রহ করে। এতে পরবর্তী নির্বাচনের আগেই রাষ্ট্র মেরামত কিংবা প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্যের প্রশ্নে আর কোনো দ্বিমত বা ভিন্নমতের অবকাশ থাকে না। এবং সেভাবেই বিভিন্ন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাব লিপিবদ্ধ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত কাজের ক্ষেত্রে অগ্রগতির তুলনায় অবিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপির মতো বড় দল দৃশ্যত ধৈর্য হারাতে থাকে এবং ক্রমেই অস্থির হয়ে ওঠে। বারবার একটি কথা অত্যন্ত বড় হয়ে জনসমক্ষে আবির্ভূত হতে শুরু করেছে। তা হলো বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ যেন গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত কিংবা সঞ্চিত ঐক্য, আকাঙ্ক্ষা এবং পরিকল্পনা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। পরিবর্তে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বাসনাই যেন অনেককে তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করেছে।
এর ফলে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হচ্ছে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের আবেদন কিংবা আকাঙ্ক্ষাটি এখন যেন তার কার্যকারিতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে না ফেললেও ধূসর গোধূলির মতো ক্রমেই অপসৃত হচ্ছে।এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।

আমাদের অতীত গণ-আন্দোলন কিংবা অভ্যুত্থানের ইতিহাসে ২০২৪ সালে সংগঠিত ছাত্র-জনতার সে মহান জাগরণ, আত্মত্যাগ কিংবা সাফল্যকে চিরভাস্বর করে রাখা আমাদের একটি জাতীয় দায়িত্ব বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে। কারণ সেটি কোনো অগণতান্ত্রিক সরকার পতনের একটি সাদামাটা আন্দোলন ছিল না। ছিল না কোনো যেনতেন ফ্যাসিবাদী সরকার হটিয়ে তথাকথিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে নতুন কোনো স্বৈরাচার কিংবা ফ্যাসিবাদ জন্ম দেওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত। এই সত্যটি দেশের কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কিংবা রাজনীতিসচেতন জনগণ অস্বীকার করতে পারবে না। তাহলে আমরা কোন যুক্তিতে জুলাই সনদ ঘোষণা কিংবা সংগ্রামী ছাত্র-জনতার একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সজ্ঞানে অগ্রাহ্য করছি? সংগ্রামী ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কৌশল কিংবা কর্মসূচিতে কিছু দুর্বলতা থাকতেই পারে। এতে সম্ভবত সাংগঠনিক দিক ছাড়াও অভিজ্ঞতা ও সময়ের আলোকে ত্রুটিপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তেরও প্রতিফলন ঘটতে পারে। তবে চূড়ান্ত বিবেচনায় নিঃসংশয়ে একটি কথা বলতে হবে যে সংগ্রামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে দেশের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির প্রশ্নে মোটামুটি সবাই ছিলেন নিঃস্বার্থ ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বহু ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও আপসহীন থাকতে হবে। নতুবা এ ক্ষেত্রে শুধু তারা নয়, জুলাই-আগস্টের সব আন্দোলন ও আত্মত্যাগ মূল্যহীন হয়ে পড়বে।বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।

ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com