অবশেষে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে গত ৩ জুন মহাপুলিশ পরিদর্শককে (আইজিপি) লেখা এক চিঠিতে পুলিশ সংস্কার কমিশনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশসমূহের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নে আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে জননিরাপত্তা বিভাগে প্রস্তাব পাঠাতেও বলা হয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের দাখিল করা কোন সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে, সেগুলোর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগের চিঠিতে।
গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ১৫ দফা সুপারিশসহ তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ সংস্কার কমিশন। এতে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী গড়তে একটি স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়।
জননিরাপত্তা বিভাগের চিঠি অনুযায়ী, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদিÑ এই তিন ধাপে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে পুলিশপ্রধানকে। চিঠিতে গ্রেপ্তার, তল্লাশি, অভিযান, মানবাধিকার সুরক্ষা, জিজ্ঞাসবাদে স্বচ্ছতা রাখা, চাকরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন, ফৌজদারি মামলার তদন্তে স্বতন্ত্র তদন্ত দল গঠন, ভুয়া ও গায়েবি মামলার চর্চা পরিত্যাগ করা, সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া তল্লাশি না করা এবং পুলিশের আভিযানিক দলের সদস্যদের জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেমের আওতায় আনাসহ বেশকিছু বিষয়ে সংস্কার কমিশনের দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর আমাদের সময়কে বলেন, পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কারকাজ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশ সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরকে চিঠি দিয়েছে, সে আলোকে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
জননিরাপত্তা বিভাগের চিঠিতে সংবিধান, বিভিন্ন আইন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ইত্যাদি পুলিশ কর্তৃক অমান্য করার কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়ার জন্য নতুন হেল্পলাইন চালু করা কিংবা ৯৯৯ কর্তৃক সেবার মধ্যে এ ধরনের অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরকে অভিযোগ দায়ের এবং তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়ার জন্য অভিযোগগুলো ইমার্জেন্সি কল সার্ভিস ট্রিপল নাইন সিস্টেমের সঙ্গে সমন্বয় করতে বলা হয়েছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ ব্যবস্থা চালু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ছিল মামলার এফআইআর গ্রহণে অনীহা অথবা বিলম্ব করা যাবে না। এ ছাড়া থানায় জিডি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোনোক্রমেই জিডি গ্রহণ প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। জননিরাপত্তা বিভাগ এসব সুপারিশ আশু বাস্তবায়ন করতে বলেছে। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে অনলাইন জিডি শুরু হয়েছে এবং অনলাইন এফআইআর ব্যবস্থা বাস্তবায়নের
কার্যক্রম চলমান আছে।
ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য একটি তদন্ত দল গঠন করতে সুপারিশ করে পুলিশ সংস্কার কমিশন। যাদের তদন্তসংক্রান্ত ইউনিট ও থানা ব্যতীত অন্যত্র বদলি করা যাবে না। ভবিষ্যতে মামলা পরিচালনা ও তদন্ত একটি ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের অধীনে পরিচালিত করতে সুপারিশ করা হয়। যারা ফৌজদারি মামলা প্রসিকিউশন-সংক্রান্ত একটি বিশেষ তদন্ত দল হবে। এক বছরের মধ্যে এই তদন্ত দল গঠনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ ধরনের তদন্ত দল গঠনের কাজ শুরু হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে চাকরিপ্রার্থীর বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা শিক্ষা সনদপত্র, ট্রান্সক্রিপ্ট মার্কশিট ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করার দায়দায়িত্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তাবে। এগুলো পুলিশ ভেরিফিকেশনের অংশ হবে না। পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই-বাছাই প্রয়োজনীয়তা রোহিত করাসহ এতদসংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধন করা যেতে পারে। তবে চাকরিপ্রার্থী বাংলাদেশের স্বাধীনতা অখণ্ডতাসংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে তার ভেরিফিকেশন রিপোর্ট প্রতিফলিত করতে হবে বলে কমিশন সুপারিশ করে। জননিরাপত্তা বিভাগ চাকরির জন্য সব পুলিশ ভেরিফিকেশন দ্রুততম সময় এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে পুুলিশ সদর দপ্তরকে।
পুলিশ সংস্কার কমিশন সুপারিশ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপরাধের ধরন শুধু ভূমি বিরোধ ও দৈনন্দিন ফৌজদারি অপরাধের জড়িত নয়। বরং সশস্ত্র সংঘাত ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক শঙ্কা ও ঝুঁকি সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য, চিটাগাং হিল ট্রাক রেগুলেশনস ১৯০০ অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক বিচার-আচার সম্পন্ন হওয়ার সংস্কৃতি এখনও চালু আছে। উপর্যুক্ত অবস্থায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত পুলিশ তাদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ সম্পাদন করতে উদ্যোগী থাকবে বলে কমিশনের সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ পুলিশ সদর দপ্তর ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে। সুপারিশ বাস্তবায়নে নির্দেশনা প্রদান এবং এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ সেমিনার আয়োজনসহ অন্যান্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এতে আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে বলে জননিরাপত্তা বিভাগের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলো শক্তিশালীকরণের অংশ হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে আটটি বিভাগ এলাকায় ৮টি কর্নার স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। যেখানে নারী মরদেহের ময়নাতদন্ত নারী পুলিশ দ্বারা সম্পন্ন করতে হবে। প্রতিটি থানায় কর্নারের অফিস স্থাপনের সম্ভাব্য ব্যয়সহ প্রস্তাব এক মাসের মধ্যে জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠাতে পুলিশ সদর দপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ এবং পুলিশ সদর দপ্তর এটি বাস্তবায়ন করবে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক দায়েরকৃত আপিল বিভাগের উক্ত রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনটি প্রত্যাহার কিংবা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে তার আলোকে প্রয়োজনে ফৌজদারি কার্যবিধিসহ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিপ্রবিধান সংশোধন করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। জননিরাপত্তা বিভাগের চিঠিতে এ ব্যাপারে প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আটক ব্যক্তি বা রিমান্ডে নেওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া পৃথক একটি জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ স্থাপনের সুপারিশ করেছিল পুলিশ সংস্কার কমিশন। জিজ্ঞাসাবাদে স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এড়াতে এই সুপারিশ করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সুপারিশ আগামী ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তরকে। অন্যদিকে নারী আসামিকে যথেষ্ট শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলা হয়েছে। এই সুপারিশ বাস্তবায়নে তিন মাস সময় বেঁধে দিয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, এখন থেকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাচের মতো স্বচ্ছ ঘর করে দেওয়া হবে। যাতে অন্যরা দেখতে পারেন আসামির সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ জন্য একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের তত্ত্বাবধানে থানা হাজত ও কোর্ট হাজতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং বন্দিদের কোর্ট থেকে আনা-নেওয়ার সময় ব্যবহারকারী যানবাহনগুলোতে মানবিক সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নতাসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির সুপারিশ করে পুলিশ সংস্কার কমিশন। তিন মাসের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে।
তল্লাশির সময় পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিতে অস্বীকার করলে অথবা সার্চ ওয়ারেন্ট না থাকলে জরুরি যোগাযোগের জন্য নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে একটি জরুরি কল সার্ভিস চালু করতে সুপারিশ করেছিল সংস্কার কমিশন। এ সুপারিশ আমলে নিয়ে এক মাসের মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরকে কলসমূহ ইমার্জেন্সি কল সার্ভিস ট্রিপল নাইনের সাথে যুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ। এ ছাড়া জব্দকৃত মালামালের যথাযথ তালিকা না হলে এবং তল্লাশি কার্যক্রমটি সন্দেহজনক মনে হলে তা তাৎক্ষণিক জানানোর জন্য মেট্রো এলাকায় ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এবং জেলায় জেলা পুলিশ সুপারের বরাবর জরুরি কল সার্ভিস চালু করতে নির্দেশ দিয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ।
সংস্কার কমিশন ভুয়া ও গায়েবি মামলায় অনিবাসী/মৃত নিরপরাধ নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূল্য ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য করার সুপারিশ করে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে মামলা দেওয়ার অপচর্চা পরিহার করতে বলে। কোনো পুলিশ সদস্য যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কাউকে এ ধরনের মামলায় হয়রানি করে, তা হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। এ ছাড়া বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না বলেও সুপারিশ করে সংস্কার কমিশন। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পুলিশ সদর দপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ।
অভিযান পরিচালনা করার সময় আইশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের কাছে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসসহ বডিওর্ন ক্যামেরা ভেস্ট, পোশাক পরিধান করতে হবে বলে সুপারিশ করেছিল সংস্কার কমিশন। জননিরাপত্তা বিভাগ এক বছরের মধ্যে এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বলেছে। এ ছাড়া পুলিশ সদর দপ্তরকে সম্ভাব্য ব্যয়সহ এ ব্যাপারে প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে।