চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার আশ^াসে আশ^স্ত বিএনপি। ভেতরে ভেতরে বেশ উৎফুল্লও দলটি। কোনো ষড়যন্ত্রে যেন নির্বাচনের সময়কাল পিছিয়ে না যায় এবং সরকার যেন দ্রুতই রোডম্যাপ ঘোষণা করে- এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনচাপ বাড়াতে মাঠে থাকবে বিএনপি। গত সোমবার রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। সরকার ও জনগণও তা-ই চায়। তবে এটি নস্যাতে ষড়যন্ত্রও আছে। এ ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় রোডম্যাপ ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি রাজপথে থাকবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে গত সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠক করে দলটির উচ্চপর্যায়ের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবেন বলে তাদের আশ^স্ত করেছেন। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রোডম্যাপ দিতে পারে সরকার।
এর আগের দিন, গত রবিবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের
সাথে বৈঠক করে বিএনপির তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। সেখান থেকে বেরিয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য আগামী মে-জুন মাসের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত হবে বলে জানিয়েছে।
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর গত সোমবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কী বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে দলটির নীতিনির্ধারকরা বেশ উৎফুল্লবোধ করছেন। তারা অবশ্য এ-ও মনে করেন যে, এর পরও বাধা আসতে পারে। কারণ, নির্বাচন প্রলম্বিত করতে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ আছে। তাই পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে দ্রুততম সময়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায় বিএনপি। এ জন্য সরকারকে চাপে রাখতে ঢাকাসহ দেশব্যাপী পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালন করবে দলটি।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর আজ বুধবার থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে দলটি। নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা এবং ফ্যাসিবাদীদের নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলাসহ বিভিন্ন জনদাবিতে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের ৬৭টি সাংগঠনিক জেলায় সভা-সমাবেশ করবে দলটি। এ কর্মসূচিতে চারটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও মূলত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিকেই ‘মূল ফোকাস’ হিসেবে তুলে ধরতে চায় বিএনপি। প্রথম দিনে আজ ছয় জেলায় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এ দিন দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় লালমনিরহাটে, নজরুল ইসলাম খান সিরাজগঞ্জে, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ খুলনায়, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল পটুয়াখালীতে, আরিফুল হক চৌধুরী সুনামগঞ্জে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন।
স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপি মনে করে জামায়াতে ইসলামী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি নির্বাচন প্রলম্বিত করতে চায়। এদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া চালু আছে। নতুন দল গঠন হলে সারাদেশে সংগঠন গোছানো ও সুসংহত করতে তাদের বেশ সময়ের প্রয়োজন।
অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াতও এখন তৃণমূলে সংগঠনকে গোছানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। বিএনপি নেতারা মনে করেন, এমন অবস্থায় দ্রুত নির্বাচন দাবিতে বিএনপি দেশব্যাপী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কৌশলে পাল্টা চাপ সৃষ্টি করলে ড. ইউনূস সরকারের পক্ষে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা সহজ হবে। এর ফলে রোডম্যাপ ঘোষণা ইস্যুতে এক ধরনের ভরসাও পাবে সরকার। কারণ, ব্যাপক জনসমাগমে সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে যে, বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল ও এর নেতাকর্মীরা সরকারের সাথে রয়েছে এবং তারা নির্বাচন দাবিতে রাজপথেও নেমেছে। তাই কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি সমাবেশ ব্যাপক জনসমাগমের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মকভাবে সফলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন নেতাকর্মীরা।
বিএনপি মনে করে, প্রধান উপদেষ্টার আশ্বাসে নির্বাচনের যে আলো দেখা গেছে, দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা হলে, তা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। একই সঙ্গে সব ধরনের সংকট কেটে যাবে, নির্বাচন নিয়ে শঙ্কাও দূর হয়ে যাবে। কারণ, রোডম্যাপ ঘোষণার পর পুরো দেশ নির্বাচনমুখী হয়ে পড়বে। দলটির নেতারা মনে করেন, পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের নানামুখী ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে অবিলম্বে একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই হতে পারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি উত্তরণের একমাত্র পথ।
রমজান শুরুর আগেই বিএনপির দেশব্যাপী সমাবেশ কর্মসূচি সম্পন্ন করা হবে। জানা গেছে, আসন্ন রমজানে রাজপথে কোনো কর্মসূচি থাকবে না দলটির। তবে ওই সময় ইফতার মাহফিলের মধ্য দিয়েও একই দাবি তুলে ধরা হবে। আর এ সময়ের মধ্যে সংস্কার এবং জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট না হলে রমজানের পর রাজপথে কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে দলটি। তখন দেশব্যাপী বিভাগ ও মহানগরে সমাবেশের কর্মসূচি আসতে পারে।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন বিএনপি নেতারা। এ ছাড়া ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ দেশজুড়ে সংঘটিত ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। বিএনপি নেতারা বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের এতদিন পর এসে তারা কোনো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিকে সমর্থন করেন না। দলীয় এ অবস্থান তারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরবেন।
বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় বলেন, দেশের মানুষ গত ১৭ বছর ধরে ভোট দিতে পারছেন না। তাদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেটাই আমরা করছি। তবে এ সরকারকে কেউ যেন ব্যর্থ করতে না পারে, সে বিষয়েও আমরা সতর্ক আছি। কারণ এ সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল।