নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় ও এর অধীন ১০ কার্যালয় এবং তিন প্রকল্পে ১৫১ কোটি ৬৫ লাখ ৩১ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিজিপি) অনুমোদন ছাড়া বেশি দামে কেনা হয়েছে ২৫৩৫টি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)।
এ বছরের ১০ মার্চ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত সাত সদস্যের দল এ নিরীক্ষা চালায়। প্রতিবেদনে ৫২টি আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম (এসএফআই) সংক্রান্ত আপত্তি রয়েছে ২১টি। পাবিলক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ না করার ২৪টি এবং অন্যান্য আর্থিক বিধিবিধান লংঘন সংক্রান্ত ২২টি আলাদা আপত্তি তোলা হয়েছে। বাকিগুলো আয়কর, ভ্যাট ও খাত পরিবর্তনসংক্রান্ত।
এদিকে প্রকল্পের অন্তত সাতটি গাড়ি সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা নিয়মের বাইরে ব্যবহার করতেন। ওই কারণে গাড়ির অপব্যবহার বেশি ছিল। নিরীক্ষায় আর্থিক অনিয়মের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখা না হলে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থার সংকট আরও প্রকট হবে বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কেএম নূরুল হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে এর প্রতিকার চেয়েছিলেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নিরীক্ষা পরিদর্শন প্রতিবেদনেও সেই একই ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠে এলো।
তিনি বলেন, এসব অনিয়মের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া এই কমিশনের নৈতিক দায়িত্ব। এছাড়া ওই সময়ের সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার এবং অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। তাদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যবস্থা নিতে পারে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করলেও তারা বিচারের ঊর্ধ্বে নন।
জানা গেছে, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি অনিয়মের আপত্তি এসেছে গত ৩০ জুন সমাপ্ত ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) প্রকল্পে (১ম পর্যায়)’। চলমান ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পেও একই আপত্তি এসেছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ইটিআই), ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয় এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের আর্থিক ব্যয়ের ওপর আপত্তি এসেছে।
ইভিএম : কমিটির নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি এবং ক্রয়সংক্রান্ত আইনবিধি পিপিআর ও পিপিএ লংঘন করে ২৫৩৫টি ইভিএম কেনা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিজিপি) অনুমোদন ছাড়া সরাসরি ৫৪ কোটি ২৭ লাখ ৩৬ হাজার ৫৫৭ টাকায় ইভিএম কেনার চুক্তি হয়। এতে পিপিএ’র ৬৮ ও পিপিআর’র ৭৫(২) বিধি লংঘন হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজন বা বিপর্যয়কর কোনো ঘটনা মোকাবিলায় জনস্বার্থে ৫০ লাখ টাকা এবং মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিবের অনুমোদনে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা ব্যয় করা যাবে। টাকার অঙ্ক এর বেশি হলে সিসিজিপির অনুমোদন নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন সিসিজিপির অনুমোদন নেয়নি। নিরীক্ষা দলের কাছে এ আপত্তির যে জবাব দিয়েছে তা নিষ্পত্তিতে সহায়ক নয়।
বাজারদর কমিটির মূল্য অপেক্ষা বেশি দামে ইভিএম কেনায় অতিরিক্ত ২৪ কোটি ৮৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এ অভিযোগের জবাবে ইসি জানিয়েছে, বাজারদর যাচাই কমিটির প্রতিবেদনে ডিসপ্লে ইউনিটের দাম ধরা হয়নি। প্রতিটি ডিসপ্লে ইউনিট ১৪ হাজার ৪০ টাকা দরে কেনা হয়েছে। যদিও নিরীক্ষা দল ডিসপ্লে ইউনিটের দাম কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে তার সপক্ষে প্রামাণিক কোনো সংযুক্তি পায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, ওই ইভিএম কেনার ক্ষেত্রে সিসিজিপির অনুমোদন নেওয়া হয়নি সত্য। বাড়তি দাম প্রসঙ্গে বলেন, এগুলো ইউনিক সোর্স থেকে কেনা হয়েছে। বাজারে ইভিএম বিক্রি হয় না। তাই বাজারদর যাচাইয়েরও কোনো সুযোগ নেই।
কেনাকাটা : ইভিএম প্রকল্পে বুদ্ধিভিত্তিক ও পেশাগত সেবা ক্রয়ের বিজ্ঞাপন সিপিটিইউর ওয়েবাসাইটে প্রকাশ করা হয়নি। কার্যালয় প্রধানের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। এভাবে তিনজন পরামর্শক পুনঃনিয়োগে ব্যয় হয়েছে ৩৬ কোটি ১৬ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। এছাড়া আইডিইএ প্রকল্পের বিভিন্ন ধরনের হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যারসহ নানা ধরনের কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ করেছে নিরীক্ষা দল। প্রতিবেদনে পিপিআর ও চুক্তিপত্রের শর্ত লংঘন করে দুই কোটি ৪৮ লাখ ৮৬ হাজার ৪২৯ টাকা ব্যয়ে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কেনার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া ডিপিপি বা বিভিআরএস সাপোর্ট সার্ভিস কেনায় আরডিপিপিতে অর্থের সংস্থান ছাড়াই অতিরিক্ত ৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা বিল দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ দিবস উপলক্ষ্যে ভবন সাজসজ্জার কাজে পেশাগত ও কারিগরি সক্ষমতা নেই এমন ঠিকাদার নিয়োগ করে এক কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এটিকেও আর্থিক অনিয়ম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়া সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নির্বাচন সামগ্রী কেনায় এক কোটি ৪ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। যা পিপিএ ও পিপিআরের বিভিন্ন ধারার লংঘন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিইএ প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও আইডিইএ (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদের যুগান্তরকে বলেন, কিছু কিছু বিষয়ে আপত্তি এসেছে। আমরা সেগুলো ওভারকাম করার চেষ্টা করছি।
গাড়ি ব্যবহার : আইডিইএ প্রকল্পে প্রাধিকারের বাইরে গাড়ি ব্যবহার, মেরামত ও জ্বালানি খরচ বাবদ বিভিন্ন অঙ্কের কয়েকটি আপত্তি এসেছে। একটিতে এক বছরে ৫২ লাখ ৯১ হাজার ৫০০ টাকা, আরেকটিতে ২৩ লাখ ১৭ হাজার ৩২০ টাকা ব্যয়ের কথা বলা আছে। এছাড়া আরও একটিতে ১৯ লাখ ৫৮ হাজার ৯০৪ টাকা এবং ভিন্ন একটিতে সিলিংয়ের অতিরিক্ত ১৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এসব ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারি আদেশের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে।
প্রশিক্ষণ : ২০২০-২১ অর্থবছরে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, রংপুর আঞ্চলিক ও জেলা অফিস এবং গাইবান্ধা জেলা অফিস প্রাপ্যতার বাইরে ২৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা সম্মানি দিয়েছে। একই প্রকল্পের আওতায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিধিমালার বাইরে গিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের খাবার বাবদ ১১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
এছাড়া প্রশিক্ষণ খাতে আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ অতিরিক্ত ৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ব্যয় করেছে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, প্রশিক্ষণ খাতে বেশ কিছু আপত্তি এসেছে। এগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।