দীর্ঘ ৩৩ বছর পর আজ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। ভোটগ্রহণের পূর্বের প্রায় সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আজ সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ। এ নির্বাচন ঘিরে মোতায়েন করা হয়েছে সহস্রাধিক পুলিশ ফোর্স। ভোটগ্রহণ থেকে গণনা পর্যন্ত সার্বক্ষণিক সতর্কাবস্থায় তাদের রাখা হবে বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন বাস্তবতায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ নির্বাচন। স্বাধীনতার পর এই প্রথম ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ নেই, অন্যদিকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। পাশাপাশি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) মতো শক্তিশালী নতুন ছাত্র সংগঠনও প্রতিযোগিতা রয়েছে। আবার দীর্ঘদিন পর ভয়মুক্ত পরিবেশে নির্বাচন করতে পারছে সর্বশেষ তিন জাকসুতে বিজয়ী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের বাইরে স্বতন্ত্র প্যানেল ও প্রার্থীরাও রয়েছেন আলোচনায়। এদিকে সদ্য অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির প্যানেলের ভূমিধস জয়ও জাকসু নির্বাচনে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
প্যানেল ও প্রার্থী : এবারের জাকসু নির্বাচনে সাদী-বৈশাখী-সাজ্জাদ
ইক্বরার নেতৃত্বে ছাত্রদল প্যানেল, আরিফ-মাজহার-ফাহিম-মেঘলার নেতৃত্বাধীন শিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’, অমর্ত্য (প্রার্থিতা বাতিল)-শরণ-স্রোত-নিকির নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সমর্থিত ‘সম্প্রীতির ঐক্য’, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ সমর্থিত উজ্জল-সিয়াম-আয়ানের নেতৃত্বে ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জিতু-শাকিলের নেতৃত্বে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ নামে পাঁচ সদস্যের একটি আংশিক প্যানেল এবং জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশের মুখপাত্র মাহফুজ ইসলামের নেতৃত্বে আট সদস্যের ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ নামে আরেকটি আংশিক প্যানেল রয়েছে। এর বাইরেও আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
প্রার্থী সংখ্যা : জাকসুর ২৫ পদে রয়েছেন ১৭৮ প্রার্থী। এর মধ্যে ১৩২ পুরুষ ও ৪৬ জন নারী। কেন্দ্রীয় সংসদের নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ৯ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৯, নারী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে ৬, পুরুষ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে ১০, শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক পদে ৯, পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সম্পাদক পদে ছয়, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে আট, সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে আট, নাট্য সম্পাদক পদে পাঁচ, ক্রীড়া সম্পাদক পদে তিন, নারী সহ-ক্রীড়া সম্পাদক পদে ছয়, পুরুষ সহ-ক্রীড়া সম্পাদক পদে ছয়, তথ্য-প্রযুক্তি ও গ্রন্থাগার সম্পাদক পদে সাত, সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক পদে আট, নারী সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক পদে সাত, পুরুষ সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক পদে সাত, স্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তাবিষয়ক সম্পাদক সাত, পরিবহন ও যোগাযোগ সম্পাদক পদে সাত, নারী কার্যকরী সদস্য পদে ১৬ এবং পুরুষ কার্যকরী সদস্য পদে ২৬ জন অংশগ্রহণ করবেন। আর বিশ^বিদ্যালয়ে মোট ২১টি সংসদ। প্রতিটি হলে ১৫টি পদ রয়েছে। ২১টি হল সংসদে মোট ৩১৫টি পদ। ১১ ছাত্র হলের প্রার্থী সংখ্যা ৩১৬ ও ১০ ছাত্রী হলের প্রার্থী সংখ্যা ১৩১ জন। সবমিলিয়ে হলে ৪৪৭ জন প্রার্থী।
বিভিন্ন হলে প্রার্থীর সংখ্যা : বিশ^বিদ্যালয়ের ২১টি হলের ১১টি ছাত্র ও ১০টি ছাত্রী হল। ছেলেদের ১১টি হলের প্রায় সব (১৫টি) পদে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। কিন্তু মেয়েদের হলে চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। হল সংসদে ১৫টি পদ হলেও কোনো হলে ছয়টি, কোথাও ১০টি আবার কোথাও ১১টি পদে মনোনয়নপত্র জমা হয়েছে। বেশিরভাগ পদেই কোনো প্রার্থী পাওয়া যায়নি।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, বিশ^বিদ্যালয়ের আ. ফ. ম কামালউদ্দিন হল, শহিদ সালাম বরকত হল এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে জমা পড়েছে ২২টি করে মনোনয়ন। মীর মোশাররফ হোসেন হল, মওলানা ভাসানী হল এবং ১০নং ছাত্র হলে জমা হয়েছে ৩০টি করে মনোনয়নপত্র। শহিদ রফিক জব্বার হল ও আল বেরুনী হলে জমা পড়েছে ২১টি মনোনয়ন। তবে ২১নং ছাত্র হল হলে ৩৮টি ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে ৬০টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলে জমা পড়েছে ৪৯টি।
অন্যদিকে, নারী শিক্ষার্থীদের জাহানারা ইমাম হলে ১৬টি, প্রীতিলতা হলে ১৩টি, বেগম খালেদা জিয়া হলে ১১টি, বেগম সুফিয়া কামাল হলে ১০টি এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা হলে জমা পড়েছে ১৫টি মনোনয়নপত্র। এ ছাড়া ১৫নং ছাত্রী হল, রোকেয়া হল ও বীরপ্রতিক তারামন বিবি হলে জমা পড়েছে ১৭টি করে মনোনয়নপত্র। সর্বনিম্নসংখ্যক মনোনয়ন ১৩নং ছাত্রী হল ও নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলে জমা পড়েছে। হল দুটিতে ১৫টি পদে মাত্র ছয়টি করে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে।
মেয়েদের হলে পদ শূন্য থাকার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, নির্বাচন কমিশনের প্রচারণার ঘাটতি এবং নারী শিক্ষার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগ্রহ কম থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া নারী নেতৃদের উদ্দেশ্যে অনলাইনে বাজে মন্তব্য ও বুলিংকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সংগঠক সোহাগি সামিয়া বলেন, জুলাইয়ে অবদান রাখা নারীদের প্রাপ্য সম্মানের বদলে হেয় করা হয়েছে। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন অনেকেই। এসব কারণে তাদের আগ্রহ কম।
ভোটার সংখ্যা : জাকসু নির্বাচনে মোট ১১ হাজার ৮৮৩ জন ভোটার। এর মধ্যে নারী ভোটার ৫ হাজার ৭২৮ ও পুরুষ ভোটার ৬ হাজার ১১৫ জন।
ভোটকেন্দ্রসমূহ : নির্বাচনে বিশ^বিদ্যালয়ের ২১টি আবাসিক হলের ২২৪টি বুথে চলবে ভোটগ্রহণ। একজন ভোটার হল সংসদের ১৫টি ও কেন্দ্রীয় ২৫টি সবমিলিয়ে ৪০টি ভোট দিতে পারবেন।
নিরাপত্তা জোরদারে থাকছে ১ হাজার ২০০ পুলিশ : আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক (সাভার, ঢাকা) জাহিদুর রহমান জানান, জাকসু নির্বাচন ঘিরে মোতায়েন করা হবে ১ হাজার ২০০ পুলিশ ফোর্স। ভোটগ্রহণ থেকে গণণা পর্যন্ত তাদের সার্বক্ষণিক সতর্কাবস্থায় রাখা হবে বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে। এরই মধ্যে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে গোটা ক্যাম্পাস। এদিন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ছাড়া কিংবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিত কেউ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবেন না। গণমাধ্যম কর্মীদের পেশাগত পরিচয় সুরক্ষার পাশাপাশি তাদেরও নির্বাচন কমিশন থেকে আলাদা পরিচয়পত্র গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। ভোট কেন্দ্রে আনসার সদস্যরা থাবেন সার্বক্ষণিক প্রহরায়। সেভাবেই নিরাপত্তার ছক এঁকেছেন সংশ্লিষ্টরা। আর পুলিশ থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত থাকবে- এমনটাই জানালেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আরাফাত ইসলাম।