আওয়ামীনীতির বাইরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক জায়গাকে নতুনভাবে গড়ে তোলা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা, একটি রাজনৈতিকভাবে সচেতন অ্যাকাডেমিক ক্যাম্পাস গড়ে তোলা, শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা, নতুন নতুন বিজ্ঞান, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির প্রতি উদ্বুদ্ধ করাসহ নির্বাচনী বিতর্কে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থীরা।
আজ শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী বিতর্কে এসব প্রতিশ্রুতি দেন তারা। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন কার্যালয়ের সহযোগিতায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি এই বিতর্কের আয়োজন করেন।
নির্বাচনী বিতর্কে ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিগত দীর্ঘদিনের শাসনামলে যে অ্যাকাডেমিক অবস্থানে ছিল, সেখানে একটি নীতিই অবশিষ্ট ছিল মুজিবনীতি বা আওয়ামীনীতি। শিক্ষক কিংবা ছাত্র, প্রত্যেক জায়গাতেই প্রায় এ নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আমরা সেই নীতির বাইরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক জায়গাকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘প্রথম বর্ষে যখন একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হন, তখন তিনি তার মেধা নিয়ে এখানে আসেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেই মেধা ধরে রাখতে পারেন না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অ্যাকাডেমিক পরিবেশ প্রয়োজন, তা অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। যেমন কিছু বিভাগে ৮০ জনের জন্য ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে ২০০ জন শিক্ষার্থী ক্লাস করছে। এই সমস্যাগুলো সমাধানে আমাদের কাজ করতে হবে।’
আবিদুল বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগে অবশ্যই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো মতাদর্শের ভিত্তিতে নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রপারলি পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিতে হলে আবাসন সমস্যার সমাধান জরুরি। আমরা সে বিষয়েও কাজ করার অঙ্গীকার করছি।’
রেজিস্ট্রার ভবনের দাপ্তরিক কাজে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডাকসুর উদ্যোগে বছরে দুই থেকে তিনবার জব ফেয়ার আয়োজন করতে চাই, যেখানে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো এসে শিক্ষার্থীদের চাকরির সুযোগ করে দেবে।’
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের বলেন, ‘একজন ভিপি প্রার্থী হিসেবে আমার প্রধান কাজ হবে—বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা। আবাসন সমস্যা সমাধান, ভর্তি নীতিমালা সহজ করা, এবং সর্বোপরি শিক্ষকদের সদিচ্ছা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না বরং পূর্বে যে কাজগুলো শুরু করেছি, নির্বাচিত হলে সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করব। আগে ইনফরমালি কাজ করায় আমরা তা করতে পারিনি, কিন্তু আনুষ্ঠানিক সুযোগ পেলে অবশ্যই শেষ করতে পারব।’
কাদের বলেন, ‘প্রথম বর্ষে এসে আমি নিজে দেখেছি, একটি সিট পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের জিম্মি থাকতে হয়, সিনিয়র ভাইয়ের পিছনে ঘুরতে হয়। একটি সিট পাওয়ার জন্য আর শিক্ষার্থীদের কষ্ট করতে হবে না। আমরা বলেছি, ওয়ান স্টুডেন্ট, ওয়ান সিট। যেদিন একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হবে, সেদিনই তার জন্য একটি সিট নিশ্চিত করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের রাজনীতির দিকেও নজর দিতে হবে। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশকে যুগোপযোগী করে সংস্কার করা জরুরি। বর্তমানে দলনির্ভর, পক্ষপাতদুষ্ট নিয়োগ ও পদায়ন প্রথা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে নষ্ট করছে। আমরা চাই—প্রশাসনের সব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হোক।’
স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা বলেন, ‘আমাদের প্যানেলের মূল লক্ষ্য হলো একটি স্বতন্ত্র, রাজনৈতিকভাবে সচেতন অ্যাকাডেমিক ক্যাম্পাস গড়ে তোলা।’
তিনি বলেন, ‘প্রথমত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্ররাজনীতির কাঠামোতে একটি বড় পরিবর্তন প্রয়োজন। এই পরিবর্তনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্র সংগঠন এবং প্রশাসনের মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির জন্য একটি উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। আমি যদি ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হই, তাহলে অবশ্যই এই কাঠামোগত সংস্কার ও নীতিমালা প্রণয়নের জন্য কাজ করব।’
উমামা বলেন, ‘ডাকসুকে কার্যকর করতে হলে প্রথমেই ডাকসুকে নিয়মিত করতে হবে। তাই নির্বাচিত হওয়ার পরপরই আমি ডাকসুর গঠনতান্ত্রিক সংশোধনের দাবি জানাব এবং নিশ্চিত করব যে প্রতি বছর নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতে নির্বাচনের আয়োজন হয়।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সিন্ডিকেট ও সিনেটে মাত্র পাঁচজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি যায়। এটি কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। আমরা চাই ডাকসুর ২৮ জন কেন্দ্রীয় পদপ্রাপ্ত প্রতিনিধি যেন সিনেট-সিন্ডিকেটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। পাশাপাশি সিন্ডিকেটের মিটিংয়েও যেন শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তি থাকে, সেটি আমরা নিশ্চিত করব।’
এ ভিপি প্রার্থী আরও বলেন, ‘যেহেতু আমি নারী প্রার্থী, তাই নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা আমার কাছে একটি প্রধান। আমরা চাইব এক হলের নারী শিক্ষার্থী যেন অন্য হলে প্রবেশ করতে পারেন। অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা যেন অন্তত বিশ্রাম নেওয়া, খাবার খাওয়া বা নামাজ পড়ার জন্য হলে প্রবেশ করতে পারেন।’
ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম বলেন, ‘আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই আমাদের স্বপ্ন থাকে একটি অ্যাকাডেমিক পরিবেশ পাবো, গবেষণার সুযোগ থাকবে, আবাসনের সমস্যা থাকবে না, স্বাস্থ্য ও খাদ্যের নিরাপত্তা থাকবে। আমরা যারা নাগরিক, তাদের জন্য এটি হবে একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস। সেই স্বপ্ন পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক রাজনৈতিক অর্জন রয়েছে, সেগুলো অবশ্যই প্রয়োজন। তবে শুধু রাজনীতি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হলো জ্ঞান অর্জন। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা, নতুন নতুন বিজ্ঞান, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের।’
সাদিক বলেন, ‘আমাদের প্রথম দাবি থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে এনে একাডেমিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। দলীয় বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই শিক্ষক নিয়োগ হতে হবে। একইসাথে শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ক্লাসে শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে পারে, সেই ব্যবস্থা তৈরি করব। শিক্ষক হবেন সিনিয়র স্কলার, আর আমরা থাকব জুনিয়র স্কলার।’