রবিবার, ০৫:৩৭ অপরাহ্ন, ২৪ অগাস্ট ২০২৫, ৯ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।
শিরোনাম :

দুর্বল হলেও ছাড় পাচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৫
  • ৭ বার পঠিত

দেশের সরকারি ব্যাংকগুলো আর প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় আসছে না। আগের মতোই বিদ্যমান সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) আওতায় ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম তদারকি ও মূল্যায়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি প্রতিটি ব্যাংকের জন্য তিন বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর্থিক সহায়তা দেবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিশ্বব্যাংক। মূলত ব্যাংকগুলোর অবস্থা দুর্বল হওয়ায় পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কে একাধিক বিধিনিষেধে পড়ার আশঙ্কায় তাদের অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করলে তারা সংকট কাটিয়ে আরও কার্যকরভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। তবে অর্থনীতিকরা বলছেন, শুধুমাত্র এমওইউর ওপর নির্ভর করে তদারকি চালানো হলে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া কঠিন হবে। তাই বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, ‘পিসিএ নীতিমালা ছাড়াও ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্সেও দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে আমি বলব, সরকারি ও বেসরকারি সব ব্যাংক একই। নীতিমালা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংককে আলাদা করা ঠিক হবে না। সরকারি ব্যাংকগুলো আগে থেকেই দুর্বল। কিন্তু এগুলো দুর্বল একদিনে হয়নি। এসব ব্যাংকেও ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। বেসরকারি খাতের ঋণ খেলাপিদের কারণেই বেশি দুর্বল হয়েছে ব্যাংকগুলো। তাই যেগুলো চলতে পারছে না, সেগুলোর বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।’

পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক হলো আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শনাক্ত করে সেগুলোর কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং উত্তরণে পদক্ষেপ গ্রহণ। আইএমএফের ঋণের শর্ত বাস্তবায়নে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই নীতিমালা জারি করা হয়। এর আওতায় পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হবে। এসব সূচকের মধ্যে আছে ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত, প্রকৃত খেলাপি ঋণ ও করপোরেট গভর্ন্যান্স বা সুশাসন। যেসব ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের বেশি এবং ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের অনুপাত (সিআরএআর) সাড়ে ১২ শতাংশের কম, সেগুলোকেই চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হবে। এরপর ক্যাটাগরি অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর পরিচালন খরচ বৃদ্ধির সীমা, লভ্যাংশ বিতরণ, নতুন শাখা খোলা, আমানত ও ঋণ বিতরণ বন্ধ এবং একীভূত করার সিদ্ধান্ত দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২৪ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। তবে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এই নীতিমালা থেকে আপাতত তাদের অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। তবে শুরুতে প্রথম ছয় ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় বিদ্যমান এমওইউর মাধ্যমে তদারকি ও মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গভর্নর তাতে সম্মতি দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতা চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। প্রতি ছয় মাস পর পর বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যগুলো পর্যালোচনা করা হবে। জানা যায়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় মূলধন ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা, ঋণ আদায় ও খেলাপি ঋণ কমানো, ঋণ বিকেন্দ্রীকরণ, উচ্চ সুদের আমানত কমানো, পরিচালন দক্ষতা বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ জোরদার ও ডিজিটাল ব্যাংকিং সক্ষমতা বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবে।

যে কারণে অব্যাহতি : সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর এই কাঠামোর প্রয়োগ চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। কারণ এসব ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারের অনেক সেবা দেওয়া হয়। আবার কৃষি, এসএমই ও বৃহৎ ঋণের একটা বড় অংশ এসব ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ও অবকাঠামো খাতে সরকারের প্রকল্প অর্থায়নের জন্যও এসব ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই ব্যাংকগুলোর ওপর পিসিএ প্রয়োগ হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কারণ, পিসিএ কাঠামোর আওতায় যেসব সূচক বিবেচনায় নেওয়া হবে, তাতে সব সূচকেই দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবে ব্যাংকগুলো। এতে সবকটি ক্যাটাগরি-৪ এ চলে যাবে। তাহলে ব্যাংকগুলোর আমানত ও ঋণ বিতরণ বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সংস্কারে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়েছে বিশ^ব্যাংক। সংস্থাটি চাচ্ছে এই সংস্কার এমওইউর মাধ্যমে হোক। তারা যেসব শর্ত দেবে, তা এমওইউর মধ্যে জুড়ে দেওয়া হবে। এ কারণে পিসিএ নীতিমালা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বিদ্যমান এমওইউর আওতায় তদারকি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। খুব দ্রুত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে চুক্তি হবে। নতুন চুক্তিতে যেসব লক্ষ্য দেওয়া হবে, তা হবে বাস্তবভিত্তিক। আগে এক বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হলেও এখন নেওয়া হবে তিন বছরের জন্য। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধনেরও জোগান দেওয়া হবে। এ জন্য সরকার থেকে একটি তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।

আর্থিক পরিস্থিতি : রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ২০০৭ সাল থেকে এমওইউ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমওইউতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তদারকি করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এত বছরেও ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। সর্বশেষ ২০২৪ সালেও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমওইউ স্বাক্ষর হয়েছিল। ব্যাংকগুলোকে বেঁধে দেওয়া বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা ও শর্ত পূরণের অগ্রগতি নিয়ে সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বৈঠকে উপস্থাপিত এমওইউর পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সবগুলো ব্যাংকই নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণে পিছিয়ে রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে জনতা ব্যাংক। ২০২৪ সাল শেষে ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৭২ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়ে। এ সময়ে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। আর মূলধন ঘাটতি ছিল ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা।

গত বছর শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপিঋণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা বা সাড়ে ১৮ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি হয় ৯ হাজার ৩০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি কাটিয়ে উদ্বৃত্ত হয় মাত্র ৮২ কোটি টাকা। ২০২৪ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় সাড়ে ৩৮ শতাংশ বা ২৭ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি ৮ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। আর মূলধন ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। ২০২৪ সাল শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৩২ শতাংশ বা ১৫ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি ৭ হাজার ২১ কোটি টাকা। আর মূলধন ঘাটতি হয় ৫ হাজার ১৯২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপিঋণ ৯৫৩ কোটি টাকা বা প্রায় ৪৪ শতাংশ। তবে ব্যাংকটির প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি নেই। বেসিক ব্যাংকের খেলাপিঋণ ৮ হাজার ৬০১ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি ৫ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকটির মূলধন নেই। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের খেলাপিঋণ ৪ হাজার ৯০২ কোটি টাকা বা ১৪.১১ শতাংশ। তবে প্রভিশন ঘাটতি নেই। তবে মূলধন ঘাটতি ছিল ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপিঋণ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বা ১৭.২৬ শতাংশ। প্রভিশন ঘাটতি নেই। তবে মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com