গত বছরের ২০ জুলাই শনিবার কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ডাকা টানা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে ব্যাপক সহিংসতায় ৩৭ জন নিহত হন। এ নিয়ে চার দিনের আন্দোলনে মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৮ জনে। ১৪ দলীয় জোটের মতামতের ভিত্তিতে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির পর সরকার দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে এবং সেনা টহল জোরদার করা হয়। একই সঙ্গে ২১ ও ২২ জুলাই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার স্পেন ও ব্রাজিল সফর বাতিল করেন।
আন্দোলন দমন করতে সরকার বিএনপি ও বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তার ও গুমের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আগের দিন গ্রেপ্তার করা বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এদিন গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে। একই দিনে ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। পরে আদালতে হাজির করা হয়।
প্রথম দফায় ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে ২০ জুলাই দুপুর ১২টা পর্যন্ত কারফিউ জারি থাকে। দুপুর ২টা থেকে আবার কারফিউ শুরু হয়ে ২১ জুলাই বিকাল ৩টা পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এ সময় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়, সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে এবং বিপণিবিতান ও দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ ২১ জুলাই থেকে পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। এদিনও সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ সেবা বন্ধ রাখে সরকার।
২০ জুলাই রাজধানীর নিউমার্কেট, সায়েন্সল্যাব, মেরুল বাড্ডা, মিরপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছোড়ে। মিরপুরে মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশনে আগুন দেওয়া হয়। ফলে মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে ও মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার বন্ধ রাখা হয়।
রায়েরবাগ, শনিরআখড়া, কাজলা ও যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যসহ বহু হতাহত হন। রামপুরা, বনশ্রী ও বাড্ডা এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। ভাটারা এলাকায় নর্থ সাউথ, ইউআইইউ ও আইইউবির শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। আজমপুরে হাইওয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। মোহাম্মদপুরের বছিলায় ও উত্তরার আজমপুর রেলগেট এলাকায় আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়।
সিদ্ধিরগঞ্জে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, একটি হাসপাতাল, ব্যাংক, রেস্টুরেন্টসহ অর্ধশতাধিক দোকানে আগুন দেওয়া হয়। শতাধিক মানুষ আটকে পড়ে, পরে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের সহায়তায় তাদের উদ্ধার করা হয়। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ, সরকারি কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর হয়। রেডিও কলোনির সংঘর্ষে ২৫ জন আহত হন।
ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশের টহল ও চেকপোস্ট বসানো হয়। কারফিউ চলাকালে বাইরে বের হতে হলে ডিএমপির কারফিউ পাস নিতে হয়। কারফিউ অমান্য করলে এক বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হবে বলে ডিএমপির গণবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
শুক্রবার দিবাগত রাতে রাজধানীর খিলগাঁও থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের সমর্থক সন্ত্রাসীরা জ্বালাও-পোড়াওসহ সহিংসতা চালাচ্ছে। যদিও এ দাবি অস্বীকার করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক সমন্বয়ক। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার দমন-পীড়ন চালিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না।’ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোটা আন্দোলনে ভর করে বিএনপি-জামায়াত দেশের মানুষকে জিম্মি করার চেষ্টা করছে। তারেক জিয়ার নির্দেশে শিবির ও ছাত্রদলের ক্যাডার বাহিনীসহ সারাদেশের সন্ত্রাসীদের ঢাকা শহরে জড়ো করা হয়েছে। এই দুষ্কৃতকারীরা সব সন্ত্রাসী ঘটনার নেতৃত্ব দিচ্ছে।’
শনিবার গভীর রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়কের সঙ্গে বৈঠক করেন সরকারের মন্ত্রীরা। এ সময় তারা সরকারের কাছে আট দফা দাবি উত্থাপন করেন। এসব দাবি মানলেই তারা কোটা সংস্কারের এক দফা দাবির বিষয়ে আলোচনা করতে সম্মত হবেন বলে জানান। বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি করেছেন, তা যৌক্তিক এবং সমাধানযোগ্য।’