কী নেই পদ্মার দক্ষিণ পারে? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থল থেকে শুরু করে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, সমুদ্রবন্দর পায়রা, শেরেবাংলার জন্মভূমি এবং অপার সৌন্দর্যের বিস্তীর্ণ উপকূল।
প্রচুর সম্ভাবনা আর ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর এ রকম অসংখ্য স্থাপনা বুকে ধারণ করলেও কেবল প্রমত্তা পদ্মার কারণে সবকিছুই যেন ছিল নক্ষত্র সমান দূরত্বে। বিশাল নদী পাড়ির ঝক্কি এড়াতে অনেকেই আসতে চাইতেন না দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই ২১ জেলায়। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এভাবে যুগের পর যুগ পিছিয়ে থাকার সেই কষ্ট দূর হচ্ছে আগামী ২৫ জুন। উদ্বোধন হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এই সেতুকে ঘিরে তাই এখন শিল্পবাণিজ্য আর পর্যটন খাতে নয়াবিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের মানুষ। পুরোদমে চলছে সম্ভাবনার নতুন ভুবনে প্রবেশের প্রস্তুতি।
রাজধানী ঢাকা থেকে সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৫শ কিলোমিটার। এক্ষেত্রে মাত্র ২৬৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থান কুয়াকাটার। এত কাছে থেকেও কুয়াকাটা পর্যটকদের মনোযোগ কাড়তে পারেনি কেবল পদ্মা নদীর কারণে। কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট সংক্ষেপে কুটুম’র চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন বিপ্লব বলেন, ‘পদ্মা আমাদের আলাদা করে রেখেছিল রাজধানী তথা সারা দেশ থেকে। এই নদীর কারণে কুয়াকাটায় বিনিয়োগের গতিও ছিল অত্যন্ত ধীর। এখন পর্যন্ত সৈকত এলাকায় শতাধিক হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ গড়ে উঠলেও তাতে নেই তেমন পেশাদারিত্ব। আমাদের সেই আক্ষেপের দিন ফুরোচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হলে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টায় রাজধানী থেকে কুয়াকাটা পৌঁছানো যাবে। পর্যটকদের ভিড়ে গমগম করবে সৈকত।
এরই মধ্যে বিপুল বিনিয়োগের আশা নিয়ে এখানে আসতে শুরু করেছে দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং শিল্প গ্রুপগুলো।’ কুয়াকাটার পাশাপাশি পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় স্থাপিত পায়রা সমুদ্রবন্দর নিয়েও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে দক্ষিণের মানুষ। বর্তমানে অপারেশনাল কার্যক্রমে থাকা পায়রাবন্দরে নিয়মিত ভিড়ছে সমুদ্রগামী জাহাজ।
মোটা অঙ্কের রাজস্বও আয় করছে বন্দর। পটুয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মুহিব্বুর রহমান বলেন, ‘রাজধানী থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় পায়রাবন্দরের দূরত্ব অর্ধেক। সাগর পাড় থেকে পণ্য পৌঁছাতেও লাগবে কম সময়। এই বিবেচনায় পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর নিঃসন্দেহে বাড়বে পায়রাবন্দরের গুরুত্ব। একইসঙ্গে গুরুত্ব বাড়বে মোংলা বন্দরেরও। কারণ পদ্মা সেতুর কারণে মোংলা থেকেও খুব কম সময়ে আমদানি পণ্য পৌঁছ যাবে ঢাকায়। সবকিছু মিলিয়ে পদ্মা সেতু দক্ষিণের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আকাশ সমান উচ্চতায়।’
অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে পদ্মার দক্ষিণ পারে। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র জলের রাজ্য। বরগুনার তালতলীতে শুভ সন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত এবং টেংরাগীরি বনাঞ্চল, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে জাহাজ মারা সৈকত, গলাচিপার কলাগাছিয়া সাগর পাড়, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার হরিণপালা এবং বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটা। বর্তমানে সামান্য সংখ্যক পর্যটক এসব দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে আসে। পর্যটনকেন্দ্রিক স্থাপনাও গড়ে ওঠেনি খুব একটা।
এগুলোর পিছিয়ে থাকার পেছনেও অন্যতম কারণ ছিল পদ্মা নদী। ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব বলেন, ‘ভোলার মনপুরা-চরফ্যাশন থেকে পটুয়াখালীর গলাচিপা-রাঙ্গাবালী হয়ে কুয়াকাটা এবং বরগুনার পাথরঘাটা-তালতলী পর্যন্ত পুরো উপকূলীয় এলাকাজুড়ে একটি এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। এই লক্ষ্যে আমরা স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয়সহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি।
বিশাল এই সম্ভাবনার পালে নতুন হাওয়া আনবে পদ্মা সেতু। সেতু চালু হলে আমরা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যে কতটা এগিয়ে যাব সেটা কেবল আমরাই জানি।’ পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য শাহজাদা সাজু বলেন, ‘এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করার ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের কাজ ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে এনেছি। বাস্তব রূপ নেওয়া পদ্মা সেতুকে ঘিরেই মূলত আবর্তিত হচ্ছে এই স্বপ্ন। সেতু চালু হলে এসব উপকূলীয় এলাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষের আগমন ঘটবে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হবে নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্রগুলো।’
পিরোজপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, ‘পুরো দক্ষিণাঞ্চলই তো একটা পর্যটনকেন্দ্র। এখানকার খাল-নদী-জঙ্গল আর সাগর পারের বিস্তীর্ণ উপকূল ঘিরে কেবল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। পৃথিবীতে এমন দেশও রয়েছে যারা কেবল পর্যটন শিল্পের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। সেখানে গর্ব করে বলতে পারি যে, পদ্মা নদীর কারণে এত বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এই দক্ষিণও এখন মাথা তুলে দাঁড়াবে পর্যটন সেক্টরে।
এই একটি পদ্মা সেতু পুরো দক্ষিণের চেহারা বদলে দেবে।’ বরগুনার আওয়ামী লীগ নেতা স্পন্দন পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান শিহাব বলেন, ‘কেবল পর্যটন খাত নয়, পদ্মা সেতু যে কীভাবে দক্ষিণের জীবনমানে উন্নয়ন ঘটাবে তা আমরা এখন কল্পনাও করতে পারছি না। সেতু চালু হওয়ার পর বিনিয়োগ হবে হাজার হাজার কোটি টাকা।’ পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক (পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা) সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। নিজের চোখে দেখার পরও বিশ্বাস হয় না চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা সেতু। মনে হয় শরীরে চিমটি কেটে দেখি।
এই নদীর জন্য অনেকে বরিশাল-খুলনা অঞ্চলে আসতে চাইত না। ২৫ জুনের পর সেই দুঃখ আর থাকবে না। এই একটি সেতুর অভাবে অনেক অবহেলিত আর পিছিয়ে পড়া জনপদ ছিল বরিশাল-খুলনা অঞ্চলের ২১ জেলা।
সেই অবহেলা আর থাকছে না। পুরো বাংলাদেশ যুক্ত হচ্ছে এক সুতোয়। তাই আমরা এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি ২৫ জুনের। যেদিন নতুন সূর্য উঠবে দক্ষিণের ভাগ্যাকাশে।’