বলা হয়ে থাকে সুঘ্রাণহীন এবং বুনটহীন খাদ্যবস্তু খেতে ঘাসের মতো বিস্বাদ লাগে। সুঘ্রাণ ছাড়া খাদ্যবস্তুর কথা চিন্তাও করা যায় না। যদি কোনো মসলা বা সুগন্ধী যৌগ না থাকতো, তাহলে আমাদের অধিকাংশ খাদ্যবস্তুই হতো নীরস, বিস্বাদ ও অরুচিকর। এই আস্বাদ জনিত কারণে খাদ্যবস্তু যে শুধু খেতেই ভালো লাগে তা কিন্তু নয়। খাদ্যবস্তুকে ভালোভাবে পরিপাকেও সহায়তা করে। নিঃসন্দেহে, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যবস্তু শুধু পুষ্টির দিক থেকে সুষম হয় না, এটি ক্ষুধাবর্ধকও হয়ে থাকে। অর্থাৎ এতে যথেষ্ট পরিমাণে সুগন্ধ থাকবে যা আমাদের গন্ধ ও আস্বাদ জনিত ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপিত করবে। অন্যথায় খাদ্যগ্রহণ আনন্দদায়ক না হয়ে বিরক্তিকর হবে।
বহুদিন আগে থেকেই মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে এমন বস্তু সংগ্রহ করার যা খাদ্যবস্তুতে সুন্দর গন্ধ যোগ করতে পারে। এরকম সুগন্ধ প্রদানের বিশাল ভান্ডার হলো উদ্ভিদজগৎ। এই সুগন্ধি দ্রব্যগুলো প্রাকৃতিকভাবেই উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফল এমনকি মূলে জমা থাকে। সুন্দর গন্ধের জন্য লবঙ্গ খুবই পরিচিত এক প্রকার মসলা এবং এটি হলো ফুলের কুঁড়ি।
কেবল বাড়ির রান্না ঘরেই সুগন্ধযুক্ত খাদ্যবস্তু তৈরি সীমাবদ্ধ নয়। আজকাল এসেন্স নামে ফ্যাক্টরিতেও সুগন্ধ তৈরি করা হচ্ছে। যেমন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ফ্যাক্টরি সুগন্ধ দ্রব্য ছাড়া চলতে পারে না। এই ফ্যাক্টরিতে প্রধানত তিন প্রকারের সুগন্ধ দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। প্রথমত প্রাকৃতিক সুগন্ধ দ্রব্য যা সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক উৎস, যা উদ্ভিদ থেকে নিষ্কাশন করা হয়। এগুলো আসলে বিভিন্ন প্রকারের সুগন্ধ যৌগের মিশ্রণ। দ্বিতীয় প্রকারে এই প্রাকৃতিক উৎসের মিশ্রণ থেকে কেবল একটি প্রধান প্রকারের সুগন্ধ যৌগ ব্যবহৃত হয়। তৃতীয় প্রকার হলো কৃত্রিম সুগন্ধ দ্রব্য যা প্রধানত সংশ্লেষিত যৌগ। শেষোক্ত প্রকারের সুগন্ধ দ্রব্য প্রাকৃতিক দ্রব্যের তুলনায় অধিকতর উদ্দীপক।
বর্তমানে আণবিক জীববিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় গাঁজন বা ফারমান্টেশন প্রক্রিয়ার উন্নতির সম্ভাবনাও যথেষ্ট উজ্জ্বল হয়েছে। বিশেষ করে অণুজীব থেকে নিঃসৃত এনজাইমের মাধ্যমে জৈব পদার্থের রাসায়নিক রূপান্তরকে বলে গাঁজান। সবচেয়ে প্রাচীন এই জৈব প্রযুক্তি পদ্ধতি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যেমন-দুধ থেকে দই তৈরি করাও এক প্রকারের গাঁজন। অণুজীব ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকারের প্রয়োজনীয় দ্রব্য, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, এনজাইম, নিউক্লিয়িক অ্যাসিড, রঞ্জক পদার্থ, স্টেরয়েড এবং ভিটামিন তৈরি সম্ভব হচ্ছে। এই প্রযুক্তির সর্বশেষ সংযোজন খাদ্যবস্তু সুগন্ধীকরণ দ্রব্য তৈরি।
বিজ্ঞানীদের মতে, শিল্পকারখানায় যে পাত্রে অণুজীব জন্মানো হয়, তাকে বলে ফারমেন্টার। এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত দ্রব্য, যা মূলত এনজাইম ও কতিপয় চিনির মতো মেটাবোলাইটস, নিষ্কাশন করে আরও প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। গাঁজনের সময় যে মেটাবোলাইট যুক্ত হয়, তা প্রধানত দু’প্রকারের-প্রাথমিক ও গৌণ। প্রথমটি এমন যৌগ যা অণুজীবের বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক এবং বিপাকীয়ভাবে এদের সংশ্লেষণ হয়। এরা হলো প্রোটিন, ভিটামিন জৈব অ্যাসিড, নিউক্লিয়িক অ্যাসিড এবং কতিপয় দ্রাবক।
অপরদিকে, গৌণ মেটাবোলাইট হলো এমন যৌগ, অণুজীবের কোষের বৃদ্ধির জন্য যাদের প্রয়োজন নেই। তাই ফারমেন্টারে ধীরে ধীরে এদের জমাকরণ মন্থর হয়ে আসে এবং খুব উচ্চমাত্রায় জমা হলে কোষের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। অ্যালকোহল, অ্যালডিহাইড, কিটোন, ইস্টার এবং টাপিনের মতো অধিকাংশ উদ্বায়ী সুগন্ধ যৌগ গৌণ মেটাবোলাইট। যখন অণুজীবের বৃদ্ধি খুব দ্রুত চলে, তখন এই যৌগ খুব কম পরিমাণে তৈরি হয়। কিন্তু যৌগগুলো বেশি পরিমাণে তৈরি হওয়ার ফলে অণুজীবের বৃদ্ধিও হ্রাস পায়। সুগন্ধ যৌগ সংশ্লেষণের জন্য গাঁজন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো আকাক্সিক্ষত যৌগ বেশি পরিমাণে তৈরি করতে পারে অনুজীবের এমন একটি বা দু’টো স্ট্রেইন শনাক্ত করা। সাধারণত পরিবেশে প্রাকৃতিকভাবে উপস্থিত অণুজীব থেকে স্ট্রেইন বাছাই করা হয়। আবার কখনো কখনো ল্যাবরেটরিতে কালচার করা অণুজীব থেকে স্ট্রেইন পৃথক করা হয়। বর্তমানে জৈব প্রযুক্তির পদ্ধতি ব্যবহার করে পছন্দমতো স্ট্রেইন তৈরি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট জিন অণুজীবে স্থানান্তর করা হয়। যা নতুন অণুজীবের স্ট্রেইনকে রূপান্তরিত করে।
একইভাবে, অণুজীব থেকে অনাকাক্সিক্ষত জিন দূরীভুত করে এদের সুগন্ধ যৌগ সংশ্লেষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ডাইঅ্যাসিটাইল (এক প্রকারের রাসায়নিক যৌগ যা কতকগুলো দুগ্ধজাত দ্রব্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান) তৈরি হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে সুগন্ধ যৌগ সংশ্লেষণ উন্নয়নের আধুনিক একটি উদাহরণ। এই যৌগের জৈব সংশ্লেষণে যে বিক্রিয়ায় স্ট্রেপ্টোকক্কাস ডাই অ্যাসিটাইল্যাকটিস ব্যাকটেরিয়াম অ্যাসিটোল্যাকটিক অ্যাসিডকে অ্যাসিটোসিনে পরিণত করে। সেই বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী এনজাইম সংশ্লেষণের জন্য দায়ী জিনকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
গবেষকরা বলেন, প্রকৃতিতে অসংখ্য অণুজীব ভেসে বেড়ায়। এগুলো খাদ্যবস্তুর ওপর ক্রিয়া করে অধিকতর সুস্বাদু খাদ্যবস্তুতে রূপান্তরিত করে। যেমন দুধ থেকে দই, ইয়োগার্ট এবং পনির তৈরি হলেও, ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেইন এগুলো তৈরিতে অংশ নেয়। এদের অনন্য সুগন্ধ ও বুনট হলো সুনির্দিষ্ট অণুজীবের দান। সুস্বাদু ও রুচিকর খাদ্যবস্তু তৈরির জন্য এসব অণুজীব ফারমেন্টারে ব্যবহৃত হয়।
খাদ্যবস্তুর প্রাণ-রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটাতে অংশ নেয় এমন এক প্রকারের অণুজীবের নাম হলো ছত্রাক। পনিরের বিভিন্ন প্রকারের সুগন্ধ সৃষ্টির জন্য ছত্রাক বহুল পরিচিত। আমরা যে মাশরুম খাই, তা ছত্রাকের ফ্রুট বডি। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতির সাহায্যে মাশরুমের বিভিন্ন স্ট্রেইন উদ্ভাবিত হয়েছে। যাদের গন্ধ ভিন্ন ভিন্ন। এই সুগন্ধের জন্য দায়ী রাসায়নিক যৌগগুলো হলো-প্রোটিন, ফ্যাটি অ্যাসিড, কার্বোহাইড্রেট এবং নিউক্লিওটাইড। বিজ্ঞানীরা জানান, বিভিন্ন মাশরুম প্রজাতিতে প্রায় দেড়শ’ প্রকারের উদ্বায়ী সুগন্ধ যৌগ শনাক্ত করা হয়েছে। সাধারণত ভোজ্য মাশরুমের উদ্বায়ী সুগন্ধ যৌগে আটটি কার্বন পরমাণু থাকে। গাঁজন ও সুগন্ধ দ্রব্য তৈরির জন্য অপর এক প্রকারের অণুজীব ঈস্ট (এক প্রকার আণুবীক্ষণিক ছত্রাক) বহুদিন আগেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গাঁজনের সময় এটি বিভিন্ন প্রকারের সুগন্ধ যৌগ তৈরি করে। এই সুগন্ধ যৌগ স্যুপ, গ্রেভি, মাংসজাত খাদ্যবস্তু এবং সামুদ্রিক খাদ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বেশি পরিমাণে সুগন্ধ যৌগ তৈরির জন্য আমাদের শুধু অণুজীবের ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন নেই। কথাটা বলেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার একটি জীব প্রযুক্তি কোম্পানি- ‘এস্কা জেনেটিক্স’ এর প্রযুক্তিবিদগণ। ভ্যানিলা গন্ধ তৈরির জন্য একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন তারা। ভ্যানিলা হলো অর্কিডেসী গোত্রের উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদ কেবল গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলেই জন্মে। ভ্যানিলার এই গন্ধের জন্য দায়ী যৌগটি হলো ভ্যানিলিন। যা ভ্যানিলা উদ্ভিদের টিস্যু কালচার, ভ্যানিলা উদ্ভিদের বিটপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে জন্মানো হয়। ক্রমাগত কোষ বিভাজনের ফলে অনেকগুলো কোষ তৈরি হয় এবং এরা একসঙ্গে লেগে থাকে। একে বলে ক্যালাস। এখান থেকে কিছু কোষ অন্য পুষ্টি মাধ্যমে জন্মানো হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতি লিটার কালচার মাধ্যমে প্রায় একশ মিলিগ্রাম ভ্যানিলিন পাওয়া যায়। টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে অন্যান্য সুগন্ধ যৌগের সংশ্লেষণের সম্ভাবনাও যথেষ্ট উজ্জ্বল।
সুগন্ধ’র উৎসের একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো মাইক্রোক্রিন ক্যাপসুলেশন। এক্ষেত্রে তরল বিন্দু, কঠিন কণা অথবা গ্যাস একটি আধারের মধ্যে রাখা হয় এবং যা থেকে খুব ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রিত হারে বের হয়ে আসে। এ আধারকে বলা হয় মাইক্রোক্যাপসুল। এর আকার এক মাইক্রনের (১ মাইক্রন= ১০-৬ মিটার) দশ ভাগের এক ভাগ থেকে কয়েক হাজার মাইক্রন পর্যন্ত হতে পারে। আলো, বাতাস এবং অন্যান্য প্রভাবক থেকে এর অভ্যন্তরের সুগন্ধ যৌগকে রক্ষা করে। এগুলো একসঙ্গে লেগে যায় না এবং ভেতরের সুগন্ধ যৌগ অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকে। এগুলো বাণিজ্যিকভাবে স্যুপ ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
অ্যানক্যাপসুলেটেড সুগন্ধ যৌগ উচ্চতাপে সুস্থির থাকে, তাই যেসব খাদ্যদ্রব্য মাইক্রোওয়েভ ওভেনে রান্না করা হয়, তাতেও এটি ব্যবহার করা যায়। এভাবেই আগামী দিনে জৈব প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে বিজ্ঞানীরা প্রত্যাশা করছেন।