ঔষধি গুণাগুণ এবং অনন্য স্বাদের জন্য পরিচিত ‘চুইঝাল’ খুলনার কৃষকদের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। গত এক দশকে এর জনপ্রিয়তা ব্যাপকহারে বেড়েছে, যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলাতেও সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে খুলনার কৃষকরা এখন বাণিজ্যিকভাবে চুইঝাল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং সঠিক ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিদেশেও এটি রপ্তানির স্বপ্ন দেখছেন অনেকে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চুইঝাল একটি সার্বজনীন মশলা জাতীয় খাবার। যে কোনো গোশত বা তরকারির স্বাদ বাড়িয়ে থাকে এটি। গোশতের পাশাপাশি চুইয়ের নানামুখী ব্যবহার শুরু হয়েছে। ঝালমুড়ি, রসুনের ঝালমুড়ি ও চানাচুর মাখা, ছোলার ঘুগনি, ছোলা ভুনা জাতীয় খাবারে এটির প্রচলন বেড়েছে ব্যাপক হারে।
এই উদ্ভিদের শিকড় থেকে শুরু করে প্রতিটি অংশই ভেষজ ক্ষমতাসম্পন্ন। তাছাড়া এই উদ্ভিদে আইসোফ্লাভোন, অ্যালকালয়েড, পিপালারিটিন, পোপিরন, পোলার্টিন, গ্লাইকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরল থাকে। এসব উপাদানের সঙ্গে থাকা অন্যান্য উপাদান ক্যানসার, হৃদরোগ, শরীর ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, গ্যাস্ট্রিক, অ্যাজমা, অনিদ্রাসহ অসংখ্য রোগের প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে। তাছাড়া চুইঝাল কফ পরিষ্কার করার পাশাপাশি সর্দি জ্বর ভালো করে। এতে থাকা ঝাঁজ ভাব যে কোনো সর্দি এবং কাশিতে বিশেষ উপকার করে। যে কোনো ব্যথা দ্রুত কমার সঙ্গে সঙ্গে চুইঝাল টনসিল ও লিভার সমস্যায় টনিক হিসাবে কাজ করে।
খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে খুলনা জেলায় প্রায় ৬০ হেক্টর জমিতে চুইঝালের চাষ হচ্ছে। হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ৪.১৭ মেট্রিক টন। সেই হিসাবে জেলায় বছরে মোট ২৫০ মেট্রিক টন চুইঝাল উৎপাদিত হয়। খুলনা জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ডুমুরিয়া উপজেলা চুঁইঝাল উৎপাদনের শীর্ষে। এ উপজেলায় ২০ হেক্টর জমিতে এই অর্থকরী ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়া পাইকগাছায় ৯ হেক্টর, বটিয়াঘাটায় ৮ হেক্টর, রূপসায় ৫ হেক্টর এবং ফুলতলায় ৫ হেক্টর জমিতে চুইঝালের চাষ হচ্ছে।
ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষক নবদ্বীপ মল্লিক জানান, সারা বছরই চুইঝালের বিক্রি হয়, তবে ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে এর চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। কুরিয়ারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ চুইঝাল সংগ্রহ করছেন। তিনি আরও জানান, তিন-চার বছর আগেও বছরে যেখানে ২-৩ হাজার চুইঝালের চারা বিক্রি হতো, এখন তা বেড়ে ৫০-৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
কৃষক নিউটন মণ্ডল জানান, আমার তিন বিঘা জমিতে চুইঝাল লাগানো ছিল। এতে বছরে ২-৩ লাখ টাকার কেনাবেচা হতো। শুধু চুই নয় চারা বিক্রি ও চুইয়ের পাউডার করেও বিক্রি করা যায়। নষ্ট হওয়া বন্ধ করতেই এ পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা কৃষি বিভাগের পরামর্শে চুইঝালের পাউডার তৈরি করে খেয়েছি, যা খুবই সুস্বাদু। তবে চুইঝাল চিবিয়ে খেয়ে যেই স্বাদ পাওয়া যায়, সেটি গুঁড়া মসলায় পাওয়া যাবে না। তবে গুঁড়া মসলায় আলাদা একটা স্বাদ রয়েছে। এই পাউডার একবার থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল। দেশের পাশাপাশি বিদেশের বাজার ধরতে পারলে চুইঝালের কদর বহুগুণে বেড়ে যাবে বলে তিনি জানান।
বর্তমানে খুলনার পাইকারি বাজারে ভালো মানের প্রতিকেজি চুইঝাল দেড় হাজার থেকে ২ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর অপেক্ষাকৃত কম দামের চুইঝাল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা স্থানভেদে পাইকারি দামের চেয়ে প্রতিকেজিতে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি নিয়ে থাকেন। সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিকেজির গড় দাম ১৩০০ টাকা ধরলে দেশে চুইঝালের বর্তমান বাজার আকার প্রায় একশ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যমতে, দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল জেলায় গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৬০০ টন চুইঝাল উৎপাদিত হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের উৎপাদন হয়েছিল ৫৫০ টন। প্রতিবছরই এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, চুইঝালের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা খুলনার কৃষকদের জন্য আশা দেখাচ্ছে। উৎপাদন লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছেন।