প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজটি পালন করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। বিদ্যমান আইন দ্রুততার সঙ্গে সংশোধন করা সম্ভব হলে আগামী বছরের বই-ই ছাপাবে এই সংস্থাটি।
আর বিলম্ব হলে ২০২৫ সালের বই ছাপানোর কাজে নেতৃত্ব দেবে অধিদপ্তর। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব ধরনের পাঠ্যবই মুদ্রণ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, যথাসময়ে পাঠ্যবই সরবরাহ, মুদ্রণ মান তদারকি ও নিশ্চিত এবং ভুলত্রুটিমুক্ত রাখার লক্ষ্যে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (প্রাগম) এক বৈঠকে ডিপিইর অধীনে মুদ্রণকাজ নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পরে সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সরকারপ্রধানের নির্বাহী অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ২৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী উল্লিখিত সিদ্ধান্তে নীতিগত অনুমোদন দেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পরই এনসিটিবির পরিবর্তে ডিপিই দরপত্র প্রক্রিয়া করে পাঠ্যবই মুদ্রণের ক্ষমতা পাওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছে।
জানতে চাইলে গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ যুগান্তরকে জানান, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নীতিগত সম্মতি দিয়েছেন। এখন যত দ্রুততার সঙ্গে এনসিটিবির আইন সংশোধন হবে, তত দ্রুত ডিপিই মুদ্রণকাজের প্রক্রিয়া করতে পারবে। যদি এটি ২-৩ মাসের মধ্যে সম্ভব হয়, তাহলে আগামী বছরের বই মুদ্রণকাজের সমন্বয়টি করা যাবে। নইলে ২০২৫ সালের কাজটি করবে ডিপিই, যার প্রক্রিয়া আগামী বছর হবে।
তিনি আরও জানান, এনসিটিবির প্রধান কাজ হচ্ছে শিক্ষাক্রমসংক্রান্ত। বই মুদ্রণের কাজটি তারা অতিরিক্ত করছে। এখন এই কাজটি করতে গিয়ে তারা ‘ওভার লোডেড’ (কাজে ভারাক্রান্ত)। তাছাড়া প্রাথমিকের বইয়ের অর্থ যায় ডিপিইতে। এই কাজের প্রশাসনিক অনুমোদন হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এনসিটিবি আরেক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। এখন প্রাথমিকের বইয়ের অর্থছাড়সহ আনুষঙ্গিক প্রশাসনিক অনুমোদন প্রক্রিয়ার জন্য সময়ক্ষেপণ হয়। সবমিলে মুদ্রণকাজে নানারকম সমন্বয়হীনতাও চলছে। এসব কারণে ডিপিইতে বই মুদ্রণের কাজটি নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাক্রম গবেষণা ও তৈরির কাজটি এনসিটিবিতেই থাকছে।
এনসিটিবির ২০১৮ সালের আইনের ৮-এর (ছ) অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকের মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিতরণ এবং বিপণন কাজ এনসিটিবির হাতে। এছাড়া এই আইনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণের ক্ষমতা ভোগ করছে এনসিটিবি। তাই এখন ডিপিইকে মুদ্রণকাজটি দিতে চাইলে আইনের এই ধারা সংশোধন প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নীতিগত অনুমোদন পাওয়ার পর প্রাগম একটি চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এছাড়া বুধবার সরাসরি এনসিটিবিতেও একটি চিঠি পাঠানো হয়। তাতে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়। চিঠিটি বৃহস্পতিবার এনসিটিবি পেয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এখন তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।
প্রাগম উপসচিব মোহাম্মদ কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, ‘এনসিটিবি আইন ২০১৮ অনুযায়ী সংস্থাটি প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের ক্ষেত্রে সময় সময় নানা জটিলতা দেখা দেওয়ায় এনসিটিবির পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের নিমিত্ত এনসিটিবি আইন ২০১৮-এর সংশ্লিষ্ট অংশের সংশোধন প্রয়োজন।’
এতে আরও বলা হয়, ‘এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানো হলে ২৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী এতে সম্মতিজ্ঞাপন/সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত সারসংক্ষেপ অনুযায়ী জরুরি ভিত্তিতে এনসিটিবি আইন ২০১৮-এর প্রয়োজনীয় সংশোধন আনয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী আছে। তাদের জন্য প্রতিবছর ১০ কোটি বই মুদ্রণ করা হয়ে থাকে। ১৪ বছর ধরে ৯৮ লটে ৩০-৩২টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব বই মুদ্রণ করা হয়ে থাকে। এই বই নিয়ে ৮-৯ বছর ধরে নানান সিন্ডিকেট কাজ করছে। কখনো চক্রবদ্ধ হয়ে ১ টাকার জিনিস ৩ টাকা দর হাঁকানোর অভিযোগ আছে। আবার কখনো ১ টাকার জিনিস ৭৫ পয়সায় দর হাঁকানোরও দৃষ্টান্ত আছে।
শেষের ঘটনার দৃষ্টান্ত ২০১৪ সালে এবং চলতি বছর ঘটেছে। আর যেহেতু বই ছাপার মূল উপকরণ কাগজ, কালিসহ অন্যান্য জিনিসের ঊর্ধ্বমূল্য সত্ত্বেও অস্বাভাবিক কম দরে বই ছাপানোর কাজ নিয়েছে, তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিম্নমানের কাগজে বিশেষ করে নিউজপ্রিন্টে বই ছাপানোর অভিযোগ আছে।
এছাড়া ১ জানুয়ারি শিক্ষাবর্ষ শুরু হলেও এক মাস পরও এই স্তরের বই সরবরাহ করতে না পারার অভিযোগ আছে। ২০১৪ সালে এবং গত বছর নিম্নমানের বই সরবরাহের অভিযোগ আছে। কিন্তু এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তা রহস্যজনক কারণে অসাধু মুদ্রাকরদের পক্ষ নিয়ে আসছেন।
সূত্র জানিয়েছে, পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ নিজেদের কবজায় নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি কারণ নেপথ্যে আছে। এর একটি হচ্ছে-গত বছর কিছু প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজে বিশেষ করে নিউজপ্রিন্টে বই সরবরাহ করেছে। ডিপিই চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানাসহ শাস্তির সুপারিশ করেছে। কিন্তু নানা কারণে এনসিটিবি সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই তৈরি নিয়ে প্রাগমের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। পিইডিপি-৪ (চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি) থেকে পাঠ্যবইয়ের অর্থের সংস্থান হয়। তাই ইউনিসেফসহ এতে অর্থায়নকারী বিদেশি সংস্থার পরামর্শ মানতে হয় প্রাথমিক মন্ত্রণালয়কে।
দাতাদের পরামর্শে ২০১৯ সালেই নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করে তারা। তাই এবার যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা’কে জোর দিয়ে শিক্ষাক্রম তৈরি ও প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে অনুমোদন করায়, তখন সেটি বাস্তবায়নে অনীহা প্রকাশ করে প্রাগম। শেষ পর্যন্ত উপর্যুপরি চাপে প্রাগম ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা’র কিছু অংশ নিয়ে এবং আগে তৈরি শিক্ষাক্রম থেকে কিছুটা সরে এসে একটি ‘খিচুড়ি মার্কা’ শিক্ষাক্রম চালু করেছে।
এর ওপর প্রথম শ্রেণিতে এবার নতুন পাঠ্যবইও দিয়েছে। কিন্তু এই দুটি দ্বন্দ্বে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এর প্রতিক্রিয়া হিসাবেই বই মুদ্রণের এই আলাদা পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাগম।
তবে আরেকটি সূত্র তৃতীয় কারণটি জানিয়েছে। তাদের মতে, বই মুদ্রণ বাবদ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ও দরপত্র প্রক্রিয়া আছে। এ খাতে ‘উচ্ছিষ্ট’ বা ‘কমিশন’ ভাগবাঁটোয়ারার বিষয়টিও নেপথ্যে থাকতে পারে।
এ বিষয়টি নিশ্চিত হতে সংশ্লিষ্টরা প্রাগমের বর্তমান ও সাবেক ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি ও কর্মকর্তা বা তাদের আত্মীয় ও নিকটজনের ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছেন।