মো. সাইফুল মিয়া (২৪)। বারো বছর বয়সে লঞ্চের ডেকে শুয়ে প্রথম পা রাখেন রাজধানীর বুকে। শুরুতে প্রায় চার বছর পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কাগজ কুড়াতেন। পরে ঘাটশ্রমিকদের সঙ্গে পরিচয়সূত্রে কুলির কাজ মেলে সদরঘাটে। এরপর থেকে এই পেশাতেই কাটিয়েছেন আট বছর। আগে দিনে আটশ থেকে বারোশ টাকা পেতেন কাজ করে। এলাকায় বিয়েও করেছেন। তবে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে সদরঘাটের পরিস্থিতি। উল্টোপথে ঘুরতে থাকে সাইফুল মিয়ার ভাগ্যের চাকাও। নৌপথে সদরঘাট থেকে যাত্রী সংকটের কারণে তিনি এখন নিজের পেশা নিয়ে শঙ্কিত। বললেন, ‘গত ছয় মাসে আয় কমেছে অর্ধেক। এখন শুনতেছি অবস্থা আরও খারাপ হবে। সামনের দিনগুলোতে কী হবে জানি না। হয়তো নতুন কোনো কাজ শুরু করতে হবে।’
প্রায় একই দশা সদরঘাটের বেশির ভাগ শ্রমিকের।। ঘাটে যাত্রী কমে যাওয়ায় আয় কমেছে প্রত্যেকের। ফলে ক্রমশ জীবনযাপন কঠিন হয়ে আসছে তাদের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছয় থেকে সাতশ শ্রমিক কাজ করতেন সদরঘাটে। বিগত ছয় মাসে সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে দুই থেকে আড়াইশতে। আয় কমার কারণে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক শ্রমিক। এ অবস্থায় বদলে গেছে সদরঘাটের চিরচেনা রূপ। যাত্রী না থাকায় সদরঘাট থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লঞ্চ কমে গেছে। কয়েকটি রুটও বন্ধ হয়ে গেছে। লঞ্চগুলো থেকে অনেক কেবিন বয়ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া যাত্রী কম থাকায় সদরঘাট থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌকর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সদরঘাট হতে রুট কমেছে ছয়টির বেশি এবং নতুন রুট যুক্ত হয়েছে দুটি। যাত্রী সংকটে কমেছে লঞ্চের সংখ্যা, কিছু রুটে চলছে অনিয়মিতভাবেও। আগে চব্বিশ ঘণ্টায় ৮৭-৮৮টি লঞ্চ চলাচল করলেও বর্তমানে চলছে ৬৮-৭০টি। এর মধ্যে ঢাকা টু বরিশাল ডে সার্ভিস, মোরেলগঞ্জ, তুসখালী, দৌলতখাঁ, টরকী, রায়েন্দা এবং দেওয়ানবাগী রুটের নৌচলাচল বন্ধ হয়েছে। অনিয়মিতভাবে চলছে মাদারীপুর, পয়সারহাট এবং পাতাবুনিয়া রুটের লঞ্চ। এ ছাড়া বরিশাল রুটে আগে
ছয়-সাতটি লঞ্চ চলাচল করলেও বর্তমানে চলছে তিন থেকে চারটি। পটুয়াখালী ও গলাচিপা রুটে আগে তিনটি চলাচল করলেও বর্তমানে চলছে দুটি এবং হুলারহাট রুটে তিনটি লঞ্চের স্থানে বর্তমানে একটি লঞ্চ চলাচল করছে।
এ নিয়ে হতাশ লঞ্চ মালিক এবং স্টাফরা। মালিকদের দাবি, গত ছয় মাসে যাত্রী কমেছে ৬০-৭০ শতাংশ। লঞ্চমালিক সমিতির সাধারণ স¤পাদক প্রিন্স আওলাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বরিশালগামী একটি লঞ্চ চলাচলে ব্যয় হয় সাত থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা। অথচ বর্তমান সময়ে যাত্রী সংকটের কারণে লঞ্চ থেকে আয় হচ্ছে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। এদিকে লঞ্চ বসিয়ে রাখলেও গাঁটের টাকা গুনতে হচ্ছে। ফলে উভয় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে তেলের দাম বৃদ্ধির পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। অনেক লঞ্চ বিকল্প পথ না থাকায় কেটে ফেলতে হয়েছে। ফলে স্টাফ ও শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছে।
এডভেঞ্চার ৯ লঞ্চের সুপারভাইজার মো মাসুদ বলেন, আগে তার লঞ্চে পঁচিশ জন কেবিন বয় কাজ করত, এখন কাজ করে মাত্র দশ জন। যাত্রী সংকটে আয় নেই, তাই বাধ্য হয়ে কাজ ছেড়েছে অনেকে। তিনি বলেন, ‘দিন দিন দ্রব্যমূল্যও বেড়ে চলেছে। আগামীতে হয়তো আরও দুর্দিন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবির বলেন, ‘যাত্রী সংখ্যা কমেছে এ কথা সত্য। আমাদের হিসাবে বিগত কয়েক মাসে ঘাটের যাত্রী থেকে আয় কমেছে ২৪ শতাংশ এবং মালামালের ওপর রাজস্ব আয় কমেছে ২৫ শতাংশ।
কিছু দিন আগেও সদরঘাটে শ্রমিকের কাজ করতেন যারা, তাদের কেউ এখন কাজ নিয়েছেন কাঁচাবাজারে, কেউ পা দিয়েছেন রিকশার প্যাডেলে কেউ বা আবার ফল ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন। কেউ বিকল্প পেশা খুঁজে না পেয়ে ফিরে গেছেন নিজের এলাকায়। রিকশাচালক রমজান আলী বলেন, ‘আগে সদরঘাটে কুলির কাম করতাম। যাত্রী কম এখন, তাই আয় হয় না সেভাবে। কম আয়ে ঢাকা শহরে থাকা যায় না। তাই তিন মাস হয়েছে রিকশা চালাইতেছি।’
শুধু ঘাটশ্রমিকই নয় যাত্রী সংকটের কারণে সদরঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দীর্ঘদিনের ব্যবসাবাণিজ্যেও লেগেছে বড় ধরনের ধাক্কা। ভোগান্তি বেড়েছে পণ্য পরিবহনকারী ট্রলারচালক শ্রমিকদেরও। পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় অনেকেই কম দামে ট্রলার বিক্রি করে দিয়ে বেকার জীবনযাপন করছেন। একই চিত্র সদরঘাটের ভাসমান ব্যবসায়ীদের। ভ্রাম্যমাণ পান-বিড়ি বিক্রেতা সুলতান মিয়া বলেন, ‘তিন পোলা এলাকায় পড়ালেখা করে, ঢাকা শহরে থেকে খেয়ে দিনে এক হাজার টাকা কামাইতে হয়। অথচ এখন ইনকাম কমেছে বহুত। শুধু এই ব্যবসা করে আর চলে না, কাঁচাবাজারের ব্যবসা করব ভাবছি।’
সব মিলিয়ে একসময় হৈহুল্লোড় ও স্টাফদের চিৎকার এবং যাত্রী-কুলিদের বাগ্বিতণ্ডায় সরগরম থাকত সদরঘাট। সংশিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, আগামীতে পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চলাচল চালু হলে হয়তো আরও দুরাশার বার্তা নিয়ে আসবে ঘাট প্রাঙ্গণে। তবে যাত্রী সংকটের কারণ হিসেবে সড়ক পথের উন্নয়নের পাশাপাশি রাজধানীর যানজট এবং ঘাটের অনিময়ের মতো বিষয়গুলোকেও দায়ী মনে করেন কেউ কেউ। তাই অনেকের দাবি, গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ফ্লাইওভার কিংবা ভিন্ন কোনো ব্যবস্থায় যানজট নিয়ন্ত্রণ করা গেলে হয়তো ফিরতে পারে লঞ্চের সুদিন।